আন্তর্জাতিক নজরুলকে কেন জাতীয় করে রেখেছি
বিশ্বখ্যাতি ও জনপ্রিয়তাই আন্তর্জাতিকতা নয়। নয় যে তার প্রমাণ-ইংরেজ বা মার্কিন বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখকরা সবাই বিশ্ববিখ্যাত, কিন্তু তাদের ৯৫ শতাংশই আন্তর্জাতিক নন।
আন্তর্জাতিকতা একটা ভাবগুরুত্ব সমকালীনতা, সর্বকালীনতা, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাস্তব উপযোগিতা। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন। শত বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতা হারাননি।
বরং তার চিন্তা ও রচনা আরও বেশি গুরুত্ব ও সমকালীন হয়ে উঠেছে। কোনো বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখকের ক্ষেত্রে যেটা হয় না। রবীন্দ্রনাথকে কী অর্থে আমরা আন্তর্জাতিক বলি? প্রথম কারণ তার চিন্তার আন্তর্জাতিকতা, দ্বিতীয়ত, তিনি কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার হয়ে কথা বলেননি।
তৃতীয়ত, তিনি বিশ্বমানুষের দার্শনিক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে যদি আঞ্চলিকতা শব্দটির প্রয়োগ না হয়, তাহলে দর্শনের ক্ষেত্রে কেন দেশভিত্তিক বা বিশ্বমানবভিত্তিক দার্শনিক শব্দবন্ধটি আসে? আমরা কেউ কিন্তু বলি না কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের বিজ্ঞান পোল্যান্ড, ইতালি কিংবা জার্মানির বিজ্ঞান। কিন্তু লক হিউম বেনথাম মিল থেকে রাসেল পর্যন্ত দর্শনের একটি ধারা বিশেষভাবেই ব্রিটিশ।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন কিন্তু ভারতীয় দর্শন নয়, বিশ্ব মানবিকতার দর্শন। ন্যাশনালিজমের ওপরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতামালা পড়লে সন্দেহ থাকে না তিনি স্বদেশিকতা ও স্বজাতীয়তাকে বহুকাল আগেই অতিক্রম করে গেছেন। ব্রিটিশ শাসনের কঠিন সময়ের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি আধুনিক বিশ্বের চিন্তাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ শুধু বৈষ্ণব পদাবলী বা লোকসাহিত্যের মাধ্যমে পুষ্ট হননি, তিনি বহুদেশ ঘুরেছেন, বিচিত্র সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, আন্তর্জাতিক নানা সংস্কৃতি, সে সংস্কৃতির প্রভাবকে নিজের লেখায় আত্মস্থ করেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশ ও সেদেশের ভাষা-সাহিত্য থেকে বিস্তর উপকরণ আহরণ করে নিজের সৃজনশীলতাকে আরও উৎকর্ষে নিয়ে গেছেন। নানা অর্থেই তিনি আন্তর্জাতিক, একইসঙ্গে প্রবলভাবে বৈশ্বিক। সফোক্লিস, শেকসপিয়র, গ্যেটে, তলস্তয় যেমন বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, রবীন্দ্রনাথও তেমন পরীক্ষিত প্রতিভা, তার অধিকাংশ লেখাই ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রাশিয়ার বরিস পাস্তারনাক, ফ্রান্সের আঁদ্রে জিৎ, স্পেনের হিমেনেথ রবীন্দ্রকাব্য অনুবাদ করেছেন তার কবিতাকে ভালোবেসেই। প্রায় সবাই স্বীকার করবেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলীর খুব ভালো অনুবাদ হয়নি। সেই অনুবাদও তাকে নোবেল এনে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বছর নোবেল পান, তার আগের বছর অমেরিকার কোনো এক সাহিত্যিক ও সমালোচক জোর তদবির চালিয়েছিলেন সাহিত্যিক হেনরি জেমসের পক্ষে যেন পুরস্কারটি তার ঝুলিতে আসে। কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাডেমির নোবেল সাহিত্য কমিটি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। বিদেশি বহু ভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনূদিত হয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, অনুবাদের প্রাচুর্যজনিত কারণে তিনি আন্তর্জাতিক। সব অর্থেই তার আন্তর্জাতিকতার পক্ষে কোনো বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন নেই। স্পেনের কবিদের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এত বেশি যে, সেখানে সবচেয়ে মর্যাদাকর কবিতা পুরস্কারের নাম রবীন্দ্র পুরস্কার। মাদ্রিদে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতি পরিষদ। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও শিক্ষাচিন্তা, কৃষি ও বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শন-কলা-চিত্রকলা চিন্তা, বলা যেতে পারে তার সব চিন্তা নিয়েই বিশ্বের দেশে দেশেই গবেষণা হয়েছে। তার কাজের মধ্যেও আন্তর্জাতিকতা ঠাঁই করে নিয়েছে। তিনি শান্তিনিকেতনে নানা দেশের নানা মত, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি একত্র করেছিলেন। চীনা-ভবন নির্মাণ করেছিলেন চীনা শিক্ষা প্রসারের জন্য। হিন্দি ভবন তৈরি করেছিলেন হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার আগেই। ইসরাইল থেকে নিয়ে এসেছিলেন আরসনকে। কেরল থেকে কেলু নায়ারকে, যবদ্বীপ থেকে বাটিক শিল্পীদের। আবার শান্তিনিকেতনের ভারতীয় শিল্পীদের পাঠিয়েছিলেন জাপানে। ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলায় সোনালি রঙের যে ব্যবহার, তা জাপানি চিত্রশিল্পীদের প্রভাবেই, যা রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্পীদের জাপান পাঠিয়ে আত্মীকরণ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সব জানালা খুলে বিশ্বহাওয়া প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বোলপুর, যা ছিল নিছক একটি গ্রাম, সেই প্রত্যন্ত গ্রামে বসে তিনি তৈরি করেছেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের মহৎ আন্তর্জাতিকতা রয়েছে তার সামগ্রিক সত্তায়, বিশ্বদৃষ্টিতে। তার ব্যক্তিত্ব একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
নজরুলের এসব কিছুই হয়নি। কিন্তু নজরুল কি তার লেখায় ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করেননি? তিনি কি বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছাননি? এ বহুদূর মানে ব্রিটেন, আমেরিকা, চীন, জাপান নয়, এই দূর মানে চিরকালীন চিরন্তন মানুষের কাছে পৌঁছানো। তাহলে নজরুল কেন আন্তর্জাতিক নন? আগেই লেখা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানে বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখক নন। আন্তর্জাতিকতা একটা ভাবগুরুত্ব, সমকালীনতা ও সর্বকালীনতা, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাস্তব উপযোগিতা।
আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা হলো চিন্তার আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বমানবের দার্শনিকতা। সে অর্থে নজরুলও আন্তর্জাতিক। নজরুল কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার হয়ে কথা বলেননি। বারবার বলেছেন ‘আমি সকল কালের সকল দেশের সকল জাতির’। তার এই বাণীকে, তার লেখনীর এ দর্শনকে কেন আমরা বিশ্বের প্রত্যন্ত বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারলাম না? কেন নজরুলকে জাতীয় করেই রাখা হলো? এর দায় কি কিছুটা হলেও নজরুল গবেষক, অনুবাদক, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলের ওপর বর্তায় না? এটা ঠিক যে, ফরাসি-জার্মান-ইংরেজ-রুশ-স্প্যানিশ বা গ্রিকভাষীরা নজরুল অনুবাদের জন্য হামলে পড়েননি। নজরুল অনুবাদের জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী অনুবাদকরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা শিখতে আসবেন, এতদূর পর্যন্ত আশা করা যায় না। কিন্তু নজরুলের আন্তর্জাতিক না হয়ে ওঠার পেছনে এই-ই একমাত্র কারণ? পৃথিবীর সব মানুষই তো প্রথমে ঘরের, তারপর পরের। রবীন্দ্রনাথও তো বাংলাতেই লিখতেন। ঠিক যে, তার মহৎ আন্তর্জাতিকতা ছিল, তার সামগ্রিক সত্তায়, বিশ্বদৃষ্টিতে। নজরুলের কি ছিল না? রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব কোনো বিশেষ অঞ্চলের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে পৌঁছেছিল অনেক দূর পর্যন্ত। ততদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি নজরুল। এও ঠিক যে, বিশ্বের কোনো প্রভাবশালী ভাষাতেই নজরুল সেই অর্থে পঠিতও নন। কিন্তু নজরুল আপাদমস্তক বাঙালি হয়েও বুকের মধ্যে যে বিশ্বভুবনটি ধরে রেখেছিলেন, সে ভুবনে কি তাকে পৌঁছে দেওয়া গেছে? পেরেছে বাংলাদেশ কিংবা বাঙালিরা? হয়তো ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় বইয়ের দোকানে আজ আর নজরুলের কোনো বই খুঁজে পাওয়া যাবে না, হয়তো দশ শতাংশ শিক্ষিত বিদেশিও নজরুলের লেখা পড়েননি। কিন্তু পাঠকের সাহিত্যবোধ কখনো পরিবর্তন হবে না, তাও তো বলা যায় না। আজ যা ভালো লাগছে, কুড়ি বছর পরে পাঠকদের ভালো লাগবে না এমনটা বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথেরও ভালো অনুবাদ হয়নি, নজরুলের হয়েছে আরও কম। আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রদেনস্টাইন বা রমা রঁলার মতো অনুরক্ত ছিল, নজরুলের সে ভাগ্য হয়নি। এখনো তো সময় শেষ হয়ে যায়নি। যথাযথ অনুবাদ করে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের নজরে নজরুল পড়বেন না এমন বলার সুযোগ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, নজরুলকে বিনোদনের উপকরণ বানিয়ে রাখা হয়েছে। নজরুলজয়ন্তী মানেই সে বাঁধাধরা কয়েকটি গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি আর পত্র-পত্রিকায় নজরুলের সাম্যবাদ জাতীয় প্রবন্ধ থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ উদ্ধৃতি, যেন সারা জীবন নজরুল শুধু এটুকুই বলে গেছেন। নজরুল গবেষণা না হয়ে হয়েছে স্তুতি, তাও নজরুলের খণ্ডিত স্তুতি। নজরুল আন্তর্জাতিক ঠিকই, আমরাই তাকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক হয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে জন্মেছেন বলে তাকে বাংলাদেশি বলা যেতে পারে কিন্তু তার মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একই কথা গান্ধীজীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিশ্বকবি উপাধিটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে খুবই মানিয়ে যায়, নজরুলের সঙ্গে হয়তো অতটা যায় না। তবে আন্তর্জাতিক ভাষায় লিখলেই যে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না, বহু কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। শেকসপিয়র, মিল্টনও আঞ্চলিক থেকে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছেন। ভলতেয়ার, রুশো, গ্যেটে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, প্লেটো, অ্যারিস্টেটল, চিনুয়া আচিবে-যার কথাই বলি না কেন, প্রথমে তারা প্রত্যেকেই আঞ্চলিক মুখপাত্র, এর পরে তারা আন্তর্জাতিক। রাজারাও, আর কে নারায়ণ, মুলুক রাজ আনন্দ, অভিতাভ ঘোষ প্রত্যেকেই প্রথমে ভারতীয় লেখক, তারপর আন্তর্জাতিক। কিন্তু নজরুলের দুর্ভাগ্য, তার চেয়েও বেশি আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এখনো তাকে আঞ্চলিকই বানিয়ে রেখেছি।
জয়া ফারহানা : প্রাবন্ধিক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
আন্তর্জাতিক নজরুলকে কেন জাতীয় করে রেখেছি
বিশ্বখ্যাতি ও জনপ্রিয়তাই আন্তর্জাতিকতা নয়। নয় যে তার প্রমাণ-ইংরেজ বা মার্কিন বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখকরা সবাই বিশ্ববিখ্যাত, কিন্তু তাদের ৯৫ শতাংশই আন্তর্জাতিক নন।
আন্তর্জাতিকতা একটা ভাবগুরুত্ব সমকালীনতা, সর্বকালীনতা, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাস্তব উপযোগিতা। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন। শত বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতা হারাননি।
বরং তার চিন্তা ও রচনা আরও বেশি গুরুত্ব ও সমকালীন হয়ে উঠেছে। কোনো বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখকের ক্ষেত্রে যেটা হয় না। রবীন্দ্রনাথকে কী অর্থে আমরা আন্তর্জাতিক বলি? প্রথম কারণ তার চিন্তার আন্তর্জাতিকতা, দ্বিতীয়ত, তিনি কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার হয়ে কথা বলেননি।
তৃতীয়ত, তিনি বিশ্বমানুষের দার্শনিক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে যদি আঞ্চলিকতা শব্দটির প্রয়োগ না হয়, তাহলে দর্শনের ক্ষেত্রে কেন দেশভিত্তিক বা বিশ্বমানবভিত্তিক দার্শনিক শব্দবন্ধটি আসে? আমরা কেউ কিন্তু বলি না কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের বিজ্ঞান পোল্যান্ড, ইতালি কিংবা জার্মানির বিজ্ঞান। কিন্তু লক হিউম বেনথাম মিল থেকে রাসেল পর্যন্ত দর্শনের একটি ধারা বিশেষভাবেই ব্রিটিশ।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন কিন্তু ভারতীয় দর্শন নয়, বিশ্ব মানবিকতার দর্শন। ন্যাশনালিজমের ওপরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতামালা পড়লে সন্দেহ থাকে না তিনি স্বদেশিকতা ও স্বজাতীয়তাকে বহুকাল আগেই অতিক্রম করে গেছেন। ব্রিটিশ শাসনের কঠিন সময়ের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি আধুনিক বিশ্বের চিন্তাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ শুধু বৈষ্ণব পদাবলী বা লোকসাহিত্যের মাধ্যমে পুষ্ট হননি, তিনি বহুদেশ ঘুরেছেন, বিচিত্র সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, আন্তর্জাতিক নানা সংস্কৃতি, সে সংস্কৃতির প্রভাবকে নিজের লেখায় আত্মস্থ করেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশ ও সেদেশের ভাষা-সাহিত্য থেকে বিস্তর উপকরণ আহরণ করে নিজের সৃজনশীলতাকে আরও উৎকর্ষে নিয়ে গেছেন। নানা অর্থেই তিনি আন্তর্জাতিক, একইসঙ্গে প্রবলভাবে বৈশ্বিক। সফোক্লিস, শেকসপিয়র, গ্যেটে, তলস্তয় যেমন বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, রবীন্দ্রনাথও তেমন পরীক্ষিত প্রতিভা, তার অধিকাংশ লেখাই ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রাশিয়ার বরিস পাস্তারনাক, ফ্রান্সের আঁদ্রে জিৎ, স্পেনের হিমেনেথ রবীন্দ্রকাব্য অনুবাদ করেছেন তার কবিতাকে ভালোবেসেই। প্রায় সবাই স্বীকার করবেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলীর খুব ভালো অনুবাদ হয়নি। সেই অনুবাদও তাকে নোবেল এনে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বছর নোবেল পান, তার আগের বছর অমেরিকার কোনো এক সাহিত্যিক ও সমালোচক জোর তদবির চালিয়েছিলেন সাহিত্যিক হেনরি জেমসের পক্ষে যেন পুরস্কারটি তার ঝুলিতে আসে। কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাডেমির নোবেল সাহিত্য কমিটি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। বিদেশি বহু ভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনূদিত হয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, অনুবাদের প্রাচুর্যজনিত কারণে তিনি আন্তর্জাতিক। সব অর্থেই তার আন্তর্জাতিকতার পক্ষে কোনো বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন নেই। স্পেনের কবিদের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এত বেশি যে, সেখানে সবচেয়ে মর্যাদাকর কবিতা পুরস্কারের নাম রবীন্দ্র পুরস্কার। মাদ্রিদে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতি পরিষদ। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও শিক্ষাচিন্তা, কৃষি ও বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শন-কলা-চিত্রকলা চিন্তা, বলা যেতে পারে তার সব চিন্তা নিয়েই বিশ্বের দেশে দেশেই গবেষণা হয়েছে। তার কাজের মধ্যেও আন্তর্জাতিকতা ঠাঁই করে নিয়েছে। তিনি শান্তিনিকেতনে নানা দেশের নানা মত, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি একত্র করেছিলেন। চীনা-ভবন নির্মাণ করেছিলেন চীনা শিক্ষা প্রসারের জন্য। হিন্দি ভবন তৈরি করেছিলেন হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার আগেই। ইসরাইল থেকে নিয়ে এসেছিলেন আরসনকে। কেরল থেকে কেলু নায়ারকে, যবদ্বীপ থেকে বাটিক শিল্পীদের। আবার শান্তিনিকেতনের ভারতীয় শিল্পীদের পাঠিয়েছিলেন জাপানে। ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলায় সোনালি রঙের যে ব্যবহার, তা জাপানি চিত্রশিল্পীদের প্রভাবেই, যা রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্পীদের জাপান পাঠিয়ে আত্মীকরণ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সব জানালা খুলে বিশ্বহাওয়া প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বোলপুর, যা ছিল নিছক একটি গ্রাম, সেই প্রত্যন্ত গ্রামে বসে তিনি তৈরি করেছেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের মহৎ আন্তর্জাতিকতা রয়েছে তার সামগ্রিক সত্তায়, বিশ্বদৃষ্টিতে। তার ব্যক্তিত্ব একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
নজরুলের এসব কিছুই হয়নি। কিন্তু নজরুল কি তার লেখায় ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করেননি? তিনি কি বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছাননি? এ বহুদূর মানে ব্রিটেন, আমেরিকা, চীন, জাপান নয়, এই দূর মানে চিরকালীন চিরন্তন মানুষের কাছে পৌঁছানো। তাহলে নজরুল কেন আন্তর্জাতিক নন? আগেই লেখা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানে বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখক নন। আন্তর্জাতিকতা একটা ভাবগুরুত্ব, সমকালীনতা ও সর্বকালীনতা, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাস্তব উপযোগিতা।
আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা হলো চিন্তার আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বমানবের দার্শনিকতা। সে অর্থে নজরুলও আন্তর্জাতিক। নজরুল কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার হয়ে কথা বলেননি। বারবার বলেছেন ‘আমি সকল কালের সকল দেশের সকল জাতির’। তার এই বাণীকে, তার লেখনীর এ দর্শনকে কেন আমরা বিশ্বের প্রত্যন্ত বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারলাম না? কেন নজরুলকে জাতীয় করেই রাখা হলো? এর দায় কি কিছুটা হলেও নজরুল গবেষক, অনুবাদক, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলের ওপর বর্তায় না? এটা ঠিক যে, ফরাসি-জার্মান-ইংরেজ-রুশ-স্প্যানিশ বা গ্রিকভাষীরা নজরুল অনুবাদের জন্য হামলে পড়েননি। নজরুল অনুবাদের জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী অনুবাদকরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা শিখতে আসবেন, এতদূর পর্যন্ত আশা করা যায় না। কিন্তু নজরুলের আন্তর্জাতিক না হয়ে ওঠার পেছনে এই-ই একমাত্র কারণ? পৃথিবীর সব মানুষই তো প্রথমে ঘরের, তারপর পরের। রবীন্দ্রনাথও তো বাংলাতেই লিখতেন। ঠিক যে, তার মহৎ আন্তর্জাতিকতা ছিল, তার সামগ্রিক সত্তায়, বিশ্বদৃষ্টিতে। নজরুলের কি ছিল না? রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব কোনো বিশেষ অঞ্চলের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে পৌঁছেছিল অনেক দূর পর্যন্ত। ততদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি নজরুল। এও ঠিক যে, বিশ্বের কোনো প্রভাবশালী ভাষাতেই নজরুল সেই অর্থে পঠিতও নন। কিন্তু নজরুল আপাদমস্তক বাঙালি হয়েও বুকের মধ্যে যে বিশ্বভুবনটি ধরে রেখেছিলেন, সে ভুবনে কি তাকে পৌঁছে দেওয়া গেছে? পেরেছে বাংলাদেশ কিংবা বাঙালিরা? হয়তো ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় বইয়ের দোকানে আজ আর নজরুলের কোনো বই খুঁজে পাওয়া যাবে না, হয়তো দশ শতাংশ শিক্ষিত বিদেশিও নজরুলের লেখা পড়েননি। কিন্তু পাঠকের সাহিত্যবোধ কখনো পরিবর্তন হবে না, তাও তো বলা যায় না। আজ যা ভালো লাগছে, কুড়ি বছর পরে পাঠকদের ভালো লাগবে না এমনটা বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথেরও ভালো অনুবাদ হয়নি, নজরুলের হয়েছে আরও কম। আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রদেনস্টাইন বা রমা রঁলার মতো অনুরক্ত ছিল, নজরুলের সে ভাগ্য হয়নি। এখনো তো সময় শেষ হয়ে যায়নি। যথাযথ অনুবাদ করে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের নজরে নজরুল পড়বেন না এমন বলার সুযোগ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, নজরুলকে বিনোদনের উপকরণ বানিয়ে রাখা হয়েছে। নজরুলজয়ন্তী মানেই সে বাঁধাধরা কয়েকটি গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি আর পত্র-পত্রিকায় নজরুলের সাম্যবাদ জাতীয় প্রবন্ধ থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ উদ্ধৃতি, যেন সারা জীবন নজরুল শুধু এটুকুই বলে গেছেন। নজরুল গবেষণা না হয়ে হয়েছে স্তুতি, তাও নজরুলের খণ্ডিত স্তুতি। নজরুল আন্তর্জাতিক ঠিকই, আমরাই তাকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক হয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে জন্মেছেন বলে তাকে বাংলাদেশি বলা যেতে পারে কিন্তু তার মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একই কথা গান্ধীজীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিশ্বকবি উপাধিটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে খুবই মানিয়ে যায়, নজরুলের সঙ্গে হয়তো অতটা যায় না। তবে আন্তর্জাতিক ভাষায় লিখলেই যে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না, বহু কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। শেকসপিয়র, মিল্টনও আঞ্চলিক থেকে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছেন। ভলতেয়ার, রুশো, গ্যেটে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, প্লেটো, অ্যারিস্টেটল, চিনুয়া আচিবে-যার কথাই বলি না কেন, প্রথমে তারা প্রত্যেকেই আঞ্চলিক মুখপাত্র, এর পরে তারা আন্তর্জাতিক। রাজারাও, আর কে নারায়ণ, মুলুক রাজ আনন্দ, অভিতাভ ঘোষ প্রত্যেকেই প্রথমে ভারতীয় লেখক, তারপর আন্তর্জাতিক। কিন্তু নজরুলের দুর্ভাগ্য, তার চেয়েও বেশি আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এখনো তাকে আঞ্চলিকই বানিয়ে রেখেছি।
জয়া ফারহানা : প্রাবন্ধিক