মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট এমন এক সময়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে নানা টানাপোড়েন চলছে। বিশেষ করে করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ছিল, ঠিক তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই প্রক্রিয়াকে সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যুদ্ধের কারণে ‘সাপ্লাই চেইন’ কার্যত অচল হয়ে পড়ার অবস্থায় চলে যায়। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই এককভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে না। কোনো দেশের অর্থনীতিতে জটিলতা সৃষ্টি হলে তার প্রভাব পড়ে অন্যান্য দেশের ওপরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে আমাদের দেশেও অভ্যন্তরীণ বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন ও দুরূহ হয়ে পড়ে। এমনই এক অবস্থায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে।
এবারের বাজেট নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহল লক্ষ করা যাচ্ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চিত্র আঁকা হয়েছে। বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন খুবই আশাপ্রদ একটি বিষয়। একইসঙ্গে ঘোষিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। গত আগস্টে স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা এপ্রিলে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনো তা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরেই রয়েছে। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশ যদি সাড়ে ৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবং একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে সেটা একটি বিরাট অর্জন হবে। যদিও এ দুটি ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কীভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’র ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলা হয়নি। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে টানাপোড়েন চলছে, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা হয়নি। বাজেটে আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কেও নেই কোনো দিকনির্দেশনা। নিকট অতীতে কোনো বছরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির প্রেক্ষিতে ১ শতাংশও বাড়েনি। সেই অবস্থায় কী করে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে? সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিশাল টার্গেট ঠিক করা হয়েছে; কিন্তু কীভাবে তা অর্জিত হবে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই লক্ষ্যে বাজেটে সঠিক এবং কার্যকর দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন ছিল। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু বাজেটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু বলাও হয়নি। এ ব্যাপারে শুধু আশা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেই আশা বাস্তবায়িত হবে সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।
বাজেট ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে তা নিয়েও কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ ঘাটতি পূরণে ১ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে থেকে ঋণ করে আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে আমাদেরই এ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আর ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত থেকে এ বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমনিতেই ব্যাংক খাত এখন উদ্বৃত্ত তারল্য সংকটে ভুগছে। সেক্ষেত্রে ব্যাংক খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ নেই। বাজেট ঘাটতি পূরণের মতো অর্থ কোত্থেকে আসবে তা একটি বড় প্রশ্ন। ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ দিন দিন কমছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে টাকা ছাপাতে হবে। আর টাকা ছাপালে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে ইতোমধ্যেই ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। আগামীতে আরও টাকা ছাপাতে হবে। এভাবে টাকা ছাপানো হলে ‘ইনফ্লেশন’ কি কমবে না বাড়বে? মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান হার কি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে? কোনোভাবেই এটি সম্ভব হবে না।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটির প্রয়োজন ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তা যেন সঠিকভাবে প্রকৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আগামীতে এ বরাদ্দের অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হবে। যারা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ পাবেন তাদের তালিকা যাতে সঠিকভাবে প্রণীত হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে তালিকা মূল্যায়ন করাও যেতে পারে। এছাড়া যিনি এ অর্থ পাবেন, তাকেই ঠিক করতে হবে কোন মাধ্যমে তিনি টাকাটা পেতে চান। সরকার থেকে এটি নির্ধারণ করে দেওয়া ঠিক হবে না।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু এ উদ্যোগে কেউই সাড়া দেয়নি। আগামী অর্থবছরে তাই বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। যেহেতু কেউ এ সুযোগ গ্রহণ করে পাচারকৃত অর্থ বিদেশ থেকে দেশে আনেননি, তাই এ ধরনের সুযোগ রহিত করে দেওয়াটাই ভালো। বাজেটে সেই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার কমে যাচ্ছে। যদিও সরকার বলছে, আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির অনুপাতে ৪ শতাংশ বাড়ানো হবে। কিন্তু তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যদিও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য খুবই প্রয়োজন। এ খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি না হলে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। সরকার বলছে, ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে কতটা সফলতা অর্জন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। কথায় বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।’ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এ কথাটি মনে রাখতে হবে। আমরা অপেক্ষায় থাকব কীভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় তা দেখার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার ‘পলিসি রেট’ বাড়িয়েছে। পলিসি রেট বাড়ানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে পলিসি রেট বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়নি। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় সস্তা হয়েছে। আমি মনে করি, ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি তুলে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা ছিল না। আমাদের দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য যে উদ্যোগ রয়েছে তা আরও জোরদার করা উচিত। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে বেকার সমস্যা সমাধানে তা অবদান রাখতে পারে। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠতে পারে। অনুলিখন : এমএ খালেক
ড. আহসান এইচ মনসুর : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশন (পিআরআই)
মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই
ড. আহসান এইচ মনসুর
০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট এমন এক সময়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে নানা টানাপোড়েন চলছে। বিশেষ করে করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ছিল, ঠিক তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই প্রক্রিয়াকে সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যুদ্ধের কারণে ‘সাপ্লাই চেইন’ কার্যত অচল হয়ে পড়ার অবস্থায় চলে যায়। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই এককভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে না। কোনো দেশের অর্থনীতিতে জটিলতা সৃষ্টি হলে তার প্রভাব পড়ে অন্যান্য দেশের ওপরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে আমাদের দেশেও অভ্যন্তরীণ বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন ও দুরূহ হয়ে পড়ে। এমনই এক অবস্থায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে।
এবারের বাজেট নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহল লক্ষ করা যাচ্ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চিত্র আঁকা হয়েছে। বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন খুবই আশাপ্রদ একটি বিষয়। একইসঙ্গে ঘোষিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। গত আগস্টে স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা এপ্রিলে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনো তা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরেই রয়েছে। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশ যদি সাড়ে ৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবং একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে সেটা একটি বিরাট অর্জন হবে। যদিও এ দুটি ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কীভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’র ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলা হয়নি। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে টানাপোড়েন চলছে, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা হয়নি। বাজেটে আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কেও নেই কোনো দিকনির্দেশনা। নিকট অতীতে কোনো বছরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির প্রেক্ষিতে ১ শতাংশও বাড়েনি। সেই অবস্থায় কী করে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে? সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিশাল টার্গেট ঠিক করা হয়েছে; কিন্তু কীভাবে তা অর্জিত হবে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই লক্ষ্যে বাজেটে সঠিক এবং কার্যকর দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন ছিল। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু বাজেটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু বলাও হয়নি। এ ব্যাপারে শুধু আশা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেই আশা বাস্তবায়িত হবে সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।
বাজেট ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে তা নিয়েও কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ ঘাটতি পূরণে ১ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে থেকে ঋণ করে আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে আমাদেরই এ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আর ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত থেকে এ বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমনিতেই ব্যাংক খাত এখন উদ্বৃত্ত তারল্য সংকটে ভুগছে। সেক্ষেত্রে ব্যাংক খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ নেই। বাজেট ঘাটতি পূরণের মতো অর্থ কোত্থেকে আসবে তা একটি বড় প্রশ্ন। ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ দিন দিন কমছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে টাকা ছাপাতে হবে। আর টাকা ছাপালে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে ইতোমধ্যেই ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। আগামীতে আরও টাকা ছাপাতে হবে। এভাবে টাকা ছাপানো হলে ‘ইনফ্লেশন’ কি কমবে না বাড়বে? মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান হার কি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে? কোনোভাবেই এটি সম্ভব হবে না।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটির প্রয়োজন ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তা যেন সঠিকভাবে প্রকৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আগামীতে এ বরাদ্দের অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হবে। যারা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ পাবেন তাদের তালিকা যাতে সঠিকভাবে প্রণীত হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে তালিকা মূল্যায়ন করাও যেতে পারে। এছাড়া যিনি এ অর্থ পাবেন, তাকেই ঠিক করতে হবে কোন মাধ্যমে তিনি টাকাটা পেতে চান। সরকার থেকে এটি নির্ধারণ করে দেওয়া ঠিক হবে না।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু এ উদ্যোগে কেউই সাড়া দেয়নি। আগামী অর্থবছরে তাই বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। যেহেতু কেউ এ সুযোগ গ্রহণ করে পাচারকৃত অর্থ বিদেশ থেকে দেশে আনেননি, তাই এ ধরনের সুযোগ রহিত করে দেওয়াটাই ভালো। বাজেটে সেই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার কমে যাচ্ছে। যদিও সরকার বলছে, আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির অনুপাতে ৪ শতাংশ বাড়ানো হবে। কিন্তু তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যদিও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য খুবই প্রয়োজন। এ খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি না হলে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। সরকার বলছে, ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে কতটা সফলতা অর্জন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। কথায় বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।’ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এ কথাটি মনে রাখতে হবে। আমরা অপেক্ষায় থাকব কীভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় তা দেখার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার ‘পলিসি রেট’ বাড়িয়েছে। পলিসি রেট বাড়ানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে পলিসি রেট বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়নি। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় সস্তা হয়েছে। আমি মনে করি, ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি তুলে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা ছিল না। আমাদের দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য যে উদ্যোগ রয়েছে তা আরও জোরদার করা উচিত। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে বেকার সমস্যা সমাধানে তা অবদান রাখতে পারে। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠতে পারে। অনুলিখন : এমএ খালেক
ড. আহসান এইচ মনসুর : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশন (পিআরআই)
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023