স্বদেশ ভাবনা
শুধু জনগণের অংশগ্রহণই কি ‘অংশগ্রহণমূলক’?
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বর্তমানে দেশে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালেও এর সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞা নির্ধারণমূলক কোনো বক্তব্য রেখেছে বলে জানা নেই। আইনজ্ঞ ও সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যে কেউ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞা নির্ধারণে কোনো বক্তব্য রেখেছেন বলেও জানা নেই। তাই কাদের অংশগ্রহণ দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করে তুলবে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী ২৯ আগস্ট গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেই সফরের অর্জন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনেকেই আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়; অংশগ্রহণমূলক করতে আপনি কী উদ্যোগ নেবেন, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়া বিবৃতিতে জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, ‘‘সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘রাজনৈতিক দল বলিতে এমন একটা অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো নামে কার্য করেন এবং কোনো রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ হইতে পৃথক কোনো অধিসঙ্ঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন।’ সুতরাং রাজনৈতিক মত প্রচারের কাজে নিয়োজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনগণ তার কাঙ্ক্ষিত দল বাছাই করে সরকার গঠনের অনুমোদন দিতে পারবে না।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হয় না, তা ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। গত কিছু উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির স্বল্পতা দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির হয়েছে। নির্বাচন ছাড়া দেশ পরিচালনায় জনগণের ‘সম্মতি’ আদায়ের আর কোনো সাংবিধানিক বিকল্প নেই।’’
প্রথমে দেখা যাক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং তারা আগামীতে বাংলাদেশে কেমন নির্বাচন দেখতে চায়। জাতিসংঘ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। ৩১ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ের এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। ২৪ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক, জাতিসংঘ এটা চায়।’
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ১০ জুলাই বাংলাদেশ সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক শেষে ইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি একথা জানান। এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইইউর সাতটি দেশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ চান।
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। ২৭ আগস্ট আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে উৎসাহিত করে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে পারে। ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে অংশীদারত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে।
সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের মার্চে বিএনপি সরকার প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা আটটি দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। এতে ওই নির্বাচন অনেকটা একদলীয় রূপ নেয়। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ফলে দেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। অন্যরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণতন্ত্রকামী বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন।
এখন দেশের বাইরে একটি সাম্প্রতিক নির্বাচনের উদাহরণ দেওয়া যাক। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) নেতা হুন সেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। সিপিপির শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এমন একটি দল রয়েছে কম্বোডিয়ায়। দলটির নাম ক্যান্ডেললাইট। জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলটিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সিপিপিসহ নামসর্বস্ব কয়েকটি দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে সিপিপির নিরঙ্কুশ বিজয় ঘোষণা করা হয়। ওদিকে নির্বাচন শেষ হতে না হতেই কম্বোডিয়ায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে বিদেশি কিছু সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত করেছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র যেসব যুক্তি দেখিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান যুক্তিটি হলো ‘দেশটির প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সিপিপি দলের কোনো শক্ত বিরোধী দল নির্বাচনে ছিল না।’ সিপিপির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডেললাইটের নির্বাচনে অনুপস্থিতিকেই এখানে বোঝানো হয়েছে।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের অংশগ্রহণকে বোঝায়নি, বরং তারা সেদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণকে একান্ত আবশ্যক মনে করেছে। এটি একটি অখণ্ডনীয় যুক্তি বলে মনে হয়। অন্যথায় বিশ্বের যেসব দেশে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেসব দেশের নির্বাচনগুলো ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’র তকমা পেয়ে যাবে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল হিসাবে আওয়ামী লীগকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য তারা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা চাইতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের কম্বোডিয়ার মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
বি.দ্র. : ১৩ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী, দেশে কেন ঊর্ধ্বমুখী?’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার নিবন্ধে ‘কমবেশি ৭০ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ১০ থেকে ১১ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ’ বাক্যটির স্থলে হবে ‘কমবেশি ৭০ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ১০ থেকে ১১ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
শুধু জনগণের অংশগ্রহণই কি ‘অংশগ্রহণমূলক’?
স্বদেশ ভাবনা
আবদুল লতিফ মণ্ডল
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বর্তমানে দেশে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালেও এর সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞা নির্ধারণমূলক কোনো বক্তব্য রেখেছে বলে জানা নেই। আইনজ্ঞ ও সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যে কেউ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞা নির্ধারণে কোনো বক্তব্য রেখেছেন বলেও জানা নেই। তাই কাদের অংশগ্রহণ দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করে তুলবে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী ২৯ আগস্ট গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেই সফরের অর্জন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনেকেই আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়; অংশগ্রহণমূলক করতে আপনি কী উদ্যোগ নেবেন, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়া বিবৃতিতে জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, ‘‘সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘রাজনৈতিক দল বলিতে এমন একটা অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো নামে কার্য করেন এবং কোনো রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ হইতে পৃথক কোনো অধিসঙ্ঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন।’ সুতরাং রাজনৈতিক মত প্রচারের কাজে নিয়োজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনগণ তার কাঙ্ক্ষিত দল বাছাই করে সরকার গঠনের অনুমোদন দিতে পারবে না।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হয় না, তা ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। গত কিছু উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির স্বল্পতা দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির হয়েছে। নির্বাচন ছাড়া দেশ পরিচালনায় জনগণের ‘সম্মতি’ আদায়ের আর কোনো সাংবিধানিক বিকল্প নেই।’’
প্রথমে দেখা যাক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং তারা আগামীতে বাংলাদেশে কেমন নির্বাচন দেখতে চায়। জাতিসংঘ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। ৩১ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ের এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। ২৪ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক, জাতিসংঘ এটা চায়।’
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ১০ জুলাই বাংলাদেশ সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক শেষে ইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি একথা জানান। এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইইউর সাতটি দেশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ চান।
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। ২৭ আগস্ট আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে উৎসাহিত করে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে পারে। ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে অংশীদারত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে।
সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের মার্চে বিএনপি সরকার প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা আটটি দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। এতে ওই নির্বাচন অনেকটা একদলীয় রূপ নেয়। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ফলে দেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। অন্যরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণতন্ত্রকামী বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন।
এখন দেশের বাইরে একটি সাম্প্রতিক নির্বাচনের উদাহরণ দেওয়া যাক। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) নেতা হুন সেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। সিপিপির শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এমন একটি দল রয়েছে কম্বোডিয়ায়। দলটির নাম ক্যান্ডেললাইট। জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলটিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সিপিপিসহ নামসর্বস্ব কয়েকটি দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে সিপিপির নিরঙ্কুশ বিজয় ঘোষণা করা হয়। ওদিকে নির্বাচন শেষ হতে না হতেই কম্বোডিয়ায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে বিদেশি কিছু সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত করেছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র যেসব যুক্তি দেখিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান যুক্তিটি হলো ‘দেশটির প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সিপিপি দলের কোনো শক্ত বিরোধী দল নির্বাচনে ছিল না।’ সিপিপির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডেললাইটের নির্বাচনে অনুপস্থিতিকেই এখানে বোঝানো হয়েছে।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের অংশগ্রহণকে বোঝায়নি, বরং তারা সেদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণকে একান্ত আবশ্যক মনে করেছে। এটি একটি অখণ্ডনীয় যুক্তি বলে মনে হয়। অন্যথায় বিশ্বের যেসব দেশে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেসব দেশের নির্বাচনগুলো ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’র তকমা পেয়ে যাবে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল হিসাবে আওয়ামী লীগকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য তারা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা চাইতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের কম্বোডিয়ার মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
বি.দ্র. : ১৩ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী, দেশে কেন ঊর্ধ্বমুখী?’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার নিবন্ধে ‘কমবেশি ৭০ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ১০ থেকে ১১ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ’ বাক্যটির স্থলে হবে ‘কমবেশি ৭০ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ১০ থেকে ১১ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023