বিএনপির জন্য পথ খোলা আছে একটাই

 এ কে এম শাহনাওয়াজ 
১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার শোভন পথ হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হেঁটে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলা। অভীষ্টে পৌঁছার জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। থাকতে হয় গণরায় মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা। সমান্য কটি আসন বেশি পেয়েই একদল সরকার গঠন করতে পারে অথবা পরিস্থিতি ভিন্ন হলে গঠিত হতে পারে কোয়ালিশন সরকার। বিরোধী দলে থেকেও দেশের সেবা করা যায়; কিন্তু এমন আদর্শিক গণতন্ত্র এখন আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার আমেরিকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ কোথাও নেই। কারও গণতন্ত্র ঘুণপোকায় বেশি কেটেছে, কারও কম। আমাদের মতো দেশগুলোতে বড় দলগুলো বিরোধী দলের অবস্থানে থাকতে চায় না। সবারই মৌমাছি স্বভাব। যেখানে মধু, সেখানেই ভনভন করে। বুদ্ধিতে, রাজনৈতিক কূটকৌশলে এগিয়ে থাকা মৌমাছিরা মধুর পাশে বেশি জটলা করবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের শক্তি-বুদ্ধির খোঁজ না করে মরিয়া হয়ে অন্য মৌমাছির দল নিজেদের শক্তি ও কৌশলের দুর্বলতা নিয়েই যদি মৌলোভী মৌমাছির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে তা আত্মহত্যারই নামান্তর হবে অথবা ‘মরব তো মরব-তোকে নিয়েই মরব’ ধরনের মানসিকতা নিয়ে দেশে অরাজকতা তৈরি করে অসাংবিধানিকভাবে তৃতীয় কোনো পক্ষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করবে।

বিএনপির এবারের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা দেখে বারবার মনে হয়েছে, দলটির নেতারা নিজেদের ওজন বুঝে আন্দোলনের ছক কাটতে পারছেন না। ক্ষমতার মসনদে পৌঁছার অস্থিরতা তাদের সুস্থ চিন্তা করতে দিচ্ছে না। বর্তমানের বাস্তবতায় দাঁড়াতে হলে অতীতের আমলনামাকে আমলে রাখতে হয়। বিএনপি নেতাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কতগুলো কারণ রয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অন্ধত্ব তৈরি হওয়া রাজনীতির একটি ক্ষতিকর দিক। রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা সাধারণত দলের প্রতি অন্ধ থাকেন। দলের প্রেক্ষাপট, যুক্তি আর তথ্য বিচার করে দলকে ভালোবাসেন না। ফলে দলের কোনো অন্যায় বা ভুলের সমালোচনা করে দলের কল্যাণ করতে জানেন না। তা তিনি শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত যেই হন। বিএনপি এদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য, আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার সঙ্গে যুক্ত নয়। জন্ম নিয়েছে সামরিক শাসনামলে। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে ১৯৭১ সালে হয়নি। বরং দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও অধিকার অর্জনের লড়াই প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল ১৯৭১-এর। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর-পূর্ব দীর্ঘ আন্দোলন-লড়াইয়ে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না তার। সময়ের সুবিধাকে তিনি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। দুর্ভাগ্য, এ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিচ্ছিন্ন হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। শুরু থেকেই তার সরকারে পাকিস্তানি প্রভাব স্পষ্ট হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারদের তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য সংবিধান কাটাছেঁড়া করে ইনডেমনিটি আদেশ জারি করেন। নানাভাবে হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করতে থাকেন। এ পাকিস্তানপ্রিয়তা আরও স্পষ্ট হয় খালেদা জিয়ার শাসনামলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত জামায়াত নেতাদের মন্ত্রিসভায় যুক্ত করতে থাকেন। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হন সরকারের থাকা বিএনপি নেতারা। এখনো বিএনপির দায়িত্বশীল নেতা প্রকাশ্যে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা ভালো ছিলাম।’ লক্ষ করবেন, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান, ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলা, জঙ্গিবাদের উত্থান সবই ঘটে এ আমলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলে যুক্ত থাকা আমার এক মেধাবী ছাত্র এখন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, দলের এসব প্রেক্ষাপট জেনেও তুমি কেন বিএনপিকে সমর্থন করো। ওর এবং ওদের মতো ছেলেদের উত্তর থেকে তিনটি তথ্য পাই। এক. মুক্তিযুদ্ধ না দেখা প্রজন্ম এবং যারা ইতিহাস চর্চায় বিচ্ছিন্ন, তাদের অনেকের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছুঁয়ে যায় না। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক অন্যায়গুলো তাদের তেমন করে ভাবায় না। জিয়াউর রহমান বিচক্ষণতার সঙ্গে এ প্রজন্মকে টার্গেট করে দেশপ্রেমহীন যুবসমাজ তৈরি করেছিলেন। দুই. পেশিশক্তি ও অর্থলোভ দেখিয়ে তরুণদের বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। তিন. আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ পছন্দ করে না বলে তারা বিএনপিকে সমর্থন করে। এ শেষ যুক্তিটি বিএনপিমনা অনেক শিক্ষিত পেশাজীবীদের মধ্যেও দেখেছি। আওয়ামী লীগ পছন্দ না করার হাজার কারণ থাকতে পারে। তাই বলে আওয়ামী লীগের বিকল্পে বিএনপিকে দাঁড় করানোর আদর্শিক ভিত্তি কী? আদর্শিক বিকল্প দল না থাকলে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা যায়; কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লাঞ্ছিত করে কীভাবে!

সুখের কথা, দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে বিপুল সাধারণ মানুষ বিবেকহীন নন। তারা দেশপ্রেমিক বলেই বিএনপির হরতাল-অবরোধে তাদের অংশগ্রহণ নেই। বিএনপি নেতারা বক্তৃতায় তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততার কথা যতই দাবি করেন, বাস্তবতাটি ভালোই বোঝেন। বিএনপি অবরোধ করছে একটি মোক্ষম সময়ে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে এ সরকারের আমল। ঊর্ধ্বগতির নিত্যপণ্যে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। তবুও সাধারণ মানুষকে কেন সম্পৃক্ত করতে পারছে না বিএনপির আন্দোলন? উত্তর খুব সহজ। সরকারবিরোধী আন্দোলনে কোনো আদর্শিক জনপ্রিয় দল নেতৃত্ব দিচ্ছে না। বিএনপির শাসনকালের অন্যায়, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ সাধারণ মানুষের মন থেকে এখনো মুছে যায়নি। মানুষ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হিসাবে দুই দলকে কাটাকাটি করে, তবে ফলাফল শূন্য হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্লাস পয়েন্ট অনেক। বাঙালির মুক্তির দীর্ঘ লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে ছিল এ দলটি। বর্তমান নেতৃত্বের নানা সমালোচনা থাকলেও অভাবনীয় অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে দেশের, যার সুফল মানুষ ভোগ করছে। এ জায়গায় ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির ভাঁড়ার তো একেবারে শূন্য। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের চোখে বিভ্রান্তির পর্দা থাকলেও সাধারণ মানুষ মুক্ত। তারা মুক্তচিন্তা করতে পারে বলেই বিএনপির আন্দোলনে তাদের সাড়া নেই।

এসব বাস্তবতা সামনে রেখে আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলনে পোড়খাওয়া প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে সফল হতে হলে রিজভী আহমদের মতো রাজনৈতিক শব্দ ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ নয়, প্রকৃত স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণমানুষকে বিএনপির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রয়োজন ছিল। এ কারণে ক্ষমতায় আসার অস্থিরতায় না থেকে প্রয়োজন ছিল তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা; কিন্তু দুটো বাস্তবতা বিএনপি নেতাদের বিভ্রান্ত করেছে। একটি হচ্ছে, অনেক বড় বিরতির পর জেলায় জেলায় ও রাজধানীতে নেতাকর্মীদের বড় বড় জমায়েত করতে পারা। এতে আনন্দিত না হয়ে নেতাদের ভাবা উচিত ছিল, আঠারো কোটি মানুষের দেশে এ সংখ্যা খুবই ছোট। আর অংশগ্রহণ করা অধিকাংশ মানুষ দলীয় কর্মী-সমর্থক। বাকিরা ভাড়াটে। একে গণবিক্ষোভ বলা যায় না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পশ্চিমাদের সহানুভূতি আদায় করা। এক্ষেত্রে বিএনপিকে সাহায্য করেছে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন গণতন্ত্রকামী দেশগুলোকে হতাশ করেছে। যে আচরণ ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে যায় না। বিষয়টিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল বিএনপি। এ দুটি বিষয় অতি বেশি আত্মবিশ্বাসী করে ফেলেছিল বিএনপি নেতাদের। আন্দোলনে নামার সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমলে আনা উচিত ছিল। প্রথমত, অধিকাংশ মানুষকে সম্পৃক্ত না করে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করা বিপজ্জনক। অন্যটি পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থ ছাড়া শেষ পর্যন্ত কারও জন্য জীবন দিয়ে দেয় না। ভাবা উচিত ছিল আওয়ামী লীগ কূটনীতির মাধ্যমে অবস্থা পালটে দিতে পারে যে কোনো সময়। এমন বাস্তবতায় ধাপে ধাপে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে দুর্বল না করে এবং জনগণের আস্থা অর্জনের পথে না হেঁটে একটি দুর্বল পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ডাক দিয়ে ফেলল। দাবি না মানলে নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহত করার ডাক দিলেন বিএনপি নেতারা।

প্রবল জনসমর্থন ছাড়া বক্তৃতার ভাষা দিয়ে হরতাল-অবরোধে মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টই বাড়ে। কোন ভরসায় মানুষ বিএনপির আন্দোলনে পেটে পাথর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়বে? আমার ধারণা, বিএনপি ও এর সমমনা দলের অনেক নেতাই বাস্তবতা বোঝেন। বোঝেন আন্দোলন ব্যর্থ হলে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তারপরও স্বপ্ন-কল্পনায় ভর করে যেভাবে গণস্বার্থবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে প্রতিদিন ক্ষুব্ধ করে তুলছেন খেটে খাওয়া ও পেশাজীবী মানুষদের। কোনো কোনো বিএনপি নেতা একান্ত আলাপনে বলেন-কী করবেন তারা, লন্ডনি রিমোট কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত হতে হচ্ছে। এ কারণেই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচিত হচ্ছে না। মেধাহীন উগ্র নেতৃত্ব বরাবরই দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।

ইতোমধ্যে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে ভারত নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও সতর্ক করেছে। কূটনীতি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা সহজেই ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারছেন। আমরা বলব, দুর্ভাগ্য বিএনপির অসংখ্য কর্মী-সমর্থকদের। ভুল নেতৃত্ব দলকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করাল। দলীয় নেতারা নিরাপদে থেকে দলান্ধ স্থানীয় নেতাকর্মীদের আন্দোলনে নামিয়ে সরকারি পীড়নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এখনো সময় আছে, গণদুর্ভোগের কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচনমুখী হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। দলকে বাঁচাতে বিএনপির জন্য এ একটি পথই খোলা আছে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন