Logo
Logo
×

বাতায়ন

ক্যানসার ভয় নয়, জয় করুন

Icon

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্যানসার ভয় নয়, জয় করুন

৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বিশ্ব ক্যানসার সম্মেলনে দিনটিকে ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’ বা ‘বিশ্ব ক্যানসার সচেতনতা দিবস’ বা ‘বিশ্ব ক্যানসার প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিবছর এ দিবসে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। যেমন ‘আমরাই পারি রুখতে’, ‘কুসংস্কার পরিহার করুন’, ‘আমরা পারি, আমিও পারি’। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘ক্যানসার পরিচর্যায় বৈষম্য দূর করি’।

দিন দিন অসংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা বেড়েই চলছে, ক্যানসার তার মধ্যে অন্যতম। উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ক্যানসার দ্বিতীয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৃতীয়। ক্যানসার শব্দটি শুনলে যে কেউ আঁতকে ওঠেন। অনেকের দৃষ্টিতে ক্যানসার মানেই মৃত্যু। এক সময় মনে করা হতো ক্যানসারের কোনো অ্যানসার (উত্তর) নেই। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতি ও অগ্রগতির ফলে এ ধারণাগুলো আর মোটেই সত্য নয়, ক্যানসারের চিকিৎসাও আর অজেয় নয়। খুব সহজেই অনেক ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব। শুধু দরকার সময়মতো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণ।

ক্যানসার বলতে সাধারণভাবে জীবকোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বোঝায়। এ কোষগুলো স্বাভাবিক নয়, বরং পরিবর্তনশীল বিধায় দেহের সাধারণ নিয়মে এদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে খুব দ্রুত এসব কোষের পরিমাণ বাড়তে পারে, কখনো কখনো এগুলো টিউমার বা চাকার মতো কিছু একটা তৈরি করে এবং একপর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ অস্বাভাবিক কোষগুলো সুস্থ স্বাভাবিক কোষগুলোকে ধ্বংস করে ও শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধার সৃষ্টি করে। এগুলো ধীরে ধীরে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোকে অকেজো করে দেয় এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ক্যানসারের কারণ

ক্যানসার যে কোনো বয়সেই হতে পারে। আবার কিছু কিছু ক্যানসার অল্প বয়সেই হয়। সাধারণত বয়স্কদের মধ্যেই ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির মধ্যেও ক্যানসারের পুরোপুরি কারণ এখনো জানা নেই। কিছু কিছু পারিপার্শ্বিক, পেশা, এমনকি জীবনযাত্রার পদ্ধতি বা কুঅভ্যাস ক্যানসারের কারণ হতে পারে, যেমন-১. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান। ২. দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস। ৩. খাদ্যাভ্যাস, যেমন-খাদ্যে ফাইবারের অভাব, ভিটামিন বা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অভাব। ৪. প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল বা রংযুক্ত খাবার। ৫. আর্সেনিকযুক্ত পানি পান। ৬. পরিবেশ দূষণ এবং কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা। ৭. বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ, যেমন সূর্যরশ্মি, অতি বেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, কসমিক-রে ইত্যাদি। ৮. কর্মস্থল বা পেশাগত কারণে অনেকের ক্যানসার হতে পারে, যেমন রেডিয়েশন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ রোদে থেকে কাজ করা, জাহাজ ভাঙার শ্রমিক, রং ও রাবার কারখানার কর্মী ইত্যাদি। ৯. বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা ইনফেকশনের ফলে ক্যানসার হতে পারে, যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এপস্টিন বার ভাইরাস, হ্যালিকোব্যাক্টর পাইলোরি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস, এইডস ভাইরাস ইত্যাদি। সিস্টেসোমা ধরনের জীবাণু মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূত্রাশয় ক্যানসারের কারণ হিসাবে বিবেচিত। ১০. অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা। ১১. কিছু কিছু ওষুধ বা চিকিৎসা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ১২. অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী, পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি। ১৩. ক্রোমোজম বা জিনের কারণেও ক্যানসার হতে পারে।

ক্যানসারের লক্ষণ

ক্যানসারের লক্ষণ নির্ভর করে কোথায় কী ধরনের ক্যানসার হয়েছে তার ওপরে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই থাকে না। দেখা গেছে, ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার পরেই তা ধরা পড়ে। তারপরও কিছু কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যেমন : ১. সুস্থ ছিলেন, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া। ২. অরুচি বা ক্ষুধামন্দা। ৩. অতিরিক্ত দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, দাঁতের গোড়ায় বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, চামড়ার নিচে জমাট রক্ত ইত্যাদি। ৪. শরীরে কোথাও চাকা বা গোটা দেখা দিলে বিশেষ করে গলায়, বগলে, কুঁচকিতে, পেটে বা মহিলাদের স্তনে। ৫. দীর্ঘদিন জ্বর থাকলে, বিশেষ করে যদি রাতের বেলা গা প্রচুর ঘামে। ৬. অনেক দিনের কাশি, যা সাধারণ চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না, বিশেষ করে বয়স্কদের বেলায় এবং কাশির সঙ্গে রক্ত এলে। ৭. গলার স্বর ভেঙে গেলে বা কাশির সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হলে। ৮. বয়স্কদের প্রস্রাব করতে সমস্যা হলে, ব্যথা হলে বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে। ৯. পায়খানার অভ্যাস পরিবর্তন হলে বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে। ১০. খাবার গিলতে অসুবিধা বা ব্যথা। ১১. বদহজম, দীর্ঘদিনের পেটে ব্যথা বা রক্তবমি। ১২. মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের পরিবর্তন হওয়া, যাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের আবার রক্তক্ষরণ হওয়া। ১৩. মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, খিচুনি, জ্ঞান হারানো, হঠাৎ বমি করা ইত্যাদি। ১৪. চামড়ায় নতুন করে রঙের পরিবর্তন, তিলের আকার বা গড়ন পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি।

তবে মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ অন্য বিভিন্ন রোগের কারণেও হতে পারে। তাই এগুলো হলেই ক্যানসার হয়েছে ভেবে কেউ যেন অযথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পড়েন।

ক্যানসারের চিকিৎসা

অনেক ক্যানসারই সময়মতো চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ক্যানসারের প্রকারভেদে, কতটুকু ছড়িয়ে গেছে, কী কী সমস্যা করছে, রোগীর বয়স কত আর শারীরিক অবস্থা কেমন-এসবের ওপর ভিত্তি করে ক্যানসারের নানারকমের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এজন্য চিকিৎসার আগেই বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষা, নানা রকমের স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা হয়। আবার অনেক ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো হয় না অথবা ছড়িয়ে গেলে চিকিৎসা করার আর উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

ক্যানসার প্রতিরোধ

এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২ শতাংশ মৃত্যুর জন্য ক্যানসার দায়ী। তাই ক্যানসার হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। একটু সচেতন হলেই ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যানসার নামক এ বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্যানসারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কারণ জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসারের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো মেনে চলা উচিত-১. ধূমপান সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা। মনে রাখতে হবে ধূমপানে বিষপান। ২. অন্যান্য তামাক জাতীয় দ্রব্য যেমন সাদা পাতা, জর্দা, গুল ইত্যাদি ব্যবহার বন্ধ করা। ৩. মদ্যপান, শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এবং অন্য সব ধরনের নেশা পরিহার করা। ৪. খাদ্যাভ্যাস সুন্দরভাবে অনুসরণ করা, যেমন সুষম খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খাওয়া, তাজা মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া, চর্বিজাতীয় ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, প্রিজারভেটিভ বা কেমিক্যালযুক্ত খাবার বর্জন, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় বর্জন, রঙিন খাদ্য ও পানীয় বর্জন ইত্যাদি। ৫. আর্সেনিকমুক্ত পানি পান নিশ্চিত করা। ৬. নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম এবং সঙ্গে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরের ওজন ঠিক রাখা। ৭. যারা কসমেটিক্স ব্যবহার করেন, তারা যেন ভেজাল ও নিুমানের কসমেটিক্স পরিহার করেন। ৮. দীর্ঘসময় সরাসরি সূর্যের নিচে না থাকা উচিত, প্রয়োজনে ছাতা বা হ্যাট ব্যবহার করা ভালো। ৯. যৌনাভ্যাসের ক্ষেত্রে সামাজিক নৈতিকতা মেনে চলা, বহু যৌনসঙ্গী বা পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনকর্ম এবং অস্বাভাবিক যৌনাচার পরিহার করা। ১০. রক্তদান বা গ্রহণ অথবা যে কোনো ইঞ্জেকশন গ্রহণের সময় এবং এন্ডোস্কপি, কলোনোস্কপি ইত্যাদি পরীক্ষার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। ১১. বেশকিছু জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা নিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব, যেমন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের টিকা ইত্যাদি। ১২. যেসব জীবাণু এবং রোগব্যাধি ক্যানসার তৈরি করতে পারে, তা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত নির্মূল করা। ১৩. কর্মক্ষেত্রে ক্যানসার হতে পারে এমন রেডিয়েশন বা কেমিক্যালের সংস্পর্শ পরিহার করা। এ ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৪. পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ু ও পানিদূষণ বন্ধ করা। ১৫. শরীরের কোথাও চাকা বা গোটা, ক্ষত, তিলের রং পরিবর্তন, দীর্ঘদিনের জ্বর, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, খাদ্যে অরুচি, পায়খানার কোনো পরিবর্তন, যেমন পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, হঠাৎ পাতলা পায়খানা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিলে অবহেলা না করা। ১৬. প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তিরই উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, যাতে শরীরে কোনো ক্যানসার দানা বাঁধতে শুরু করলে তা প্রাথমিক অবস্থাতেই দমন করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে বয়স্কদের বৃহদান্ত্র বা কোলন, মহিলাদের জরায়ুমুখ ও স্তন, পুরুষদের প্রোস্টেট ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বীকৃত। এসব স্থানে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় এগুলোকে নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব।

আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যানসার মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়। একটু সচেতন হলেই ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি ক্যানসার হয়েও যায়, তবুও শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে তার ভালো চিকিৎসা করা যায়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। ক্যানসার নামক এ বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা। তাই এ প্রাণঘাতী রোগটিকে ভয় নয়, জয় করাই হোক সবার লক্ষ্য।

ডা. এবিএম আবদুল্লাহ : ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম