Logo
Logo
×

আনন্দ নগর

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী

সিনেমার পর্দায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় দলিল

মুক্তির সময় ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমার পোস্টারে লেখা ছিল ‘লাঞ্ছিত নারীদের মর্যাদা দাও’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত হয়ে যেসব নারী মা হতে বাধ্য হয়েছিলেন, পৃথিবীতে আসা সেসব যুদ্ধশিশুকে বরণ করে নেওয়ার তীব্র আকুতি ছিল এ সিনেমায়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় সিনেমা। পরিচালক সুভাস দত্ত মুক্তিযুদ্ধকেই উপজীব্য করে এ সিনেমা বানিয়েছেন। তবে গৎবাঁধা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা থেকে এটি একেবারেই আলাদা। উপস্থাপন এবং নির্মানশৈলীতেও ছিল ভিন্নতা। এর মধ্য দিয়ে পরিচালক পর্দায় প্রথম যুদ্ধশিশুদের অধিকার নিয়ে দাবি উত্থাপন করেন।

Icon

আনন্দনগর প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’- জনপ্রিয় এ গানটি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমার। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় এক বছর পরই ১৯৭২ সালের ১০ নভেম্বর মুক্তি পায় সিনেমাটি। মানুষের মানসপটে তখনও মুক্তিযুদ্ধ সজীব। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে যখন অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি নানারকম সমস্যায় দেশ ও জাতি জর্জরিত, ঠিক তখন এ সিনেমা বানালেন সুভাস দত্ত। অনেকের মতে, সংকটাপন্ন মুহূর্তে পরিচালক এ সিনেমা বানিয়েছেন, সেটি নিখুঁত কিনা ভেবে দেখার কোনো অবকাশ নেই, নিখুঁত হওয়ারও প্রয়োজন নেই। তবে এটিই আজ কালজয়ী সিনেমা।

পরিচালক সুভাষ দত্ত নিজের জীবনের গ্লানি, সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে না পারার মর্মবেদনা, একজন শিল্পীর পলায়নপর মনোবৃত্তি, বলতে গেলে অকপটেই স্বীকার করেছেন এ সিনেমায়। নিজের জীবনবোধ থেকে তৈরি এ সিনেমা পণ্য হিসাবে নয়, শিল্পপণ্য হিসাবেই নির্মাণ করেছিলেন দত্ত, এমনটাই বলছেন সিনেবোদ্ধারা। এ সিনেমায় পরিচালক তার যুদ্ধের সময়ের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের ফলে যুদ্ধশিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সমাজের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন। তবে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও অনেক হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানানোর মতো যথেষ্ট উপাদান থাকা সত্ত্বেও কেন যুদ্ধশিশুদের বেছে নিয়েছেন পরিচালক? এ ছাড়া কথা উঠেছে, দত্তের সিনেমায় কেন ধর্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব পেল। তবে আলোচনায় উঠে এসেছে, পরিচালক এ সিনেমায় যুদ্ধের নানা সংকটময় দিকগুলোর কয়েকটি মাত্র তুলে ধরেছেন। সেখানে যেমন দোষের কিছু নেই, তেমনি তার মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন ছিল, সেই বিতর্কও অনর্থক।

বাংলার শান্তিময় প্রকৃতি। কাশফুল, ফসলের মাঠ, বাউলের একতারায় বেজে ওঠা সুর, এই শান্তির দেশে হঠাৎ ঘনিয়ে আসে গুলির শব্দ। প্রতিবাদে মুষ্ঠিবদ্ধ হয় জনতার হাত। জন্ম হয় নতুন শিশুর। এ রূপক দৃশ্যের মাধ্যমে শুরু হয় ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমাটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর যে কটি সিনেমা মুক্তিযুদ্ধকে সার্থকভাবে ধারণ করেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।

গল্পে দেখা যায়, তরুণ কৃষক আসাদকে ভালোবাসে রোমেনা। তার পরিবারও আসাদকে পছন্দ করে। ফলে রোমেনার বাড়িতে আসাদের ছিল অবাধ যাতায়াত। একদিন গ্রামে সিনেমার শুটিং করতে আসেন নায়ক আনোয়ার হোসেন। গ্রামের সবার সঙ্গে শুটিং দেখতে যান রোমেনা ও আসাদ। সেখানে তাদের কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। এদিকে পঁচিশে মার্চ রাত থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন, হত্যা ও ধর্ষণের তাণ্ডব। শিশুদের হত্যা করা হয়, নারীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। রোমেনাদের বাড়িতেও ঘাতকরা আসে, তার বাবা মাকে হত্যা করে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শরণার্থীরা দলে দলে ছুটে যায় ভারতীয় সীমান্তের দিকে। শরণার্থী দলের সঙ্গে সীমান্তের দিকে পাড়ি জমান নায়ক আনোয়ার হোসেন। পথে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে আশ্রয় নেন ঝোঁপের আড়ালে। শেষ রক্ষা হয়নি, ধরা পড়েন তিনি। বন্দি অবস্থায় আনোয়ার হোসেন দেখেন কি নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে বাঙালি নারীদের ওপর। হত্যা করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু সিনেমার নায়ক হওয়ায় এবং নিরীহ ব্যক্তি মনে করে আনোয়ারকে ছেড়ে দেয় পাকিস্তানিরা। ছাড়া পেয়ে তারও ইচ্ছা হয় যুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু মৃত্যুর ভয় গ্রাস করে তাকে। তিনি যুদ্ধে যেতে পারেন না। পালিয়ে যান কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হলে, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার যুদ্ধাহত নারীদের সঙ্গে ক্যাম্প থেকে রোমেনাকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধা বদরুদ্দিন। রোমেনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। এদিকে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রামে ফেরেন আনোয়ার হোসেন। রোমেনার গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুকে কোলে তুলে নেন তিনি। তার উপলব্ধি হয় এই শিশুরা স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের লগ্নে জন্ম নিয়েছে, এরাও সমাজের অংশ।

সুভাষ দত্তের পরিচালনায় সিনেমাটি প্রযোজনা করেছেন রমলা সাহা, পরিবেশক ছিল যমুনা কথাচিত্র। সংগীত পরিচালনা করেন সত্য সাহা। সিনেমাতে ব্যবহৃত হয় আপেল মাহমুদের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’ গানটি। এতে রোমেনা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন ববিতা। এতে আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটিও ছিল সিনেমাটির ভিন্ন এক আবেদন। আসাদ চরিত্রে অভিনয় করেন উজ্জ্বল। বিভিন্ন ভূমিকায় আরও অভিনয় করেছেন খোকন, মাসুদ, মাস্টার লুলু, সুভাস দত্ত প্রমুখ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান, নারীর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের বীভৎস নির্যাতন, সামাজিক অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আশ্রয় শিবিরের পরিস্থিতি-এ সব কিছুই সার্থকভাবে তুলে ধরে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে ধ্রুপদীর মর্যাদা পেয়েছে।

সুভাস দত্ত, একজন অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। দেশের প্রথম সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’র পোস্টারের কাজ করেছেন তিনি। নিজেকে সিনেমার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত করেন ১৯৫৯ সালে। পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন একটি কমেডি চরিত্রে। চিত্রনাট্য লেখায়ও পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ সিনেমা দিয়ে তিনি নির্মাণের যাত্রা শুরু করেন। তার নির্মিত সর্বশেষ সিনেমা ‘আমার ছেলে’ (২০০৮)। সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এই নির্মাতা এবং অভিনেতা ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর মারা যান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম