মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ‘রক্তাক্ত বাংলা’
‘রক্তাক্ত বাংলা’-১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঢাকাই সিনেমা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা তথ্যচিত্রের ব্যবহার, ট্যাংক, কামান আর যুদ্ধবিমানের দৃশ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা ও শিল্পীদের গানে সমৃদ্ধ একটি যুদ্ধের স্মৃতিবাহী সিনেমা হয়ে এটি আজও টিকে আছে। স্বাধীনতায় অর্ধশতাব্দী পরও এটি যুদ্ধের সেই রক্তক্ষরণের দৃশ্য হয়ে আজও চোখে ভাসে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক হাতেগোনা যে কটি সিনেমায় বাংলাদেশ ও কলকাতার শিল্পীরা অভিনয় করেছেন তার একটি হলো এই সিনেমা। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
রিয়েল তন্ময়
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা, মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে নির্দয় নির্মম শাসন-শোষণ জারি করে রেখেছে। মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা এই কারাগারের অচল হয়ে যাওয়া আয়তনটাকে এবার ভাঙতে হবে। এত বড় এই পাথরটাকে শিল্পী ধ্বংস করে নতুন একটা শৈল্পিক রূপ দেন। পাথরের ভেতরে প্রাণ জাগ্রত করে মানুষের মুখের আদলে মানুষ গড়ে তোলেন। একটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শিকলমুক্ত করে মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে শেখান। এখানেই শিল্পীর মুক্তি, শিল্পসত্তার মুক্তি। তেমনই এক ভাস্কর্যশিল্পীর কথা, শিল্পী থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প বলা হয় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমায়। বাংলার গ্রামের শান্তিময় দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় সিনেমা। যেখানে দেখা যায়, যুদ্ধশেষে দেশে ফিরছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপরই ফ্ল্যাশব্যাকে মূল কাহিনি দেখা যায়। ফর্মূলা ফিল্মের সব ছক মেনে করা এ সিনেমায় পাকিস্তানি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া নারীর নাচ গানও আছে। তাদের নাচ ও গানের এ দুর্বলতার মাঝেই আক্রমণ চালায় শাহেদ ও মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের দল এবং পরাজিত করে পাকিস্তানি সেনাদের। তাদের আত্মসমর্পণের দৃশ্য, যুদ্ধবিমানের এবং কিছু পাকিস্তানি সেনাকে বহন করা ট্রেন ধ্বংস করার দৃশ্য যেমন আছে, তেমনই এ সিনেমায় আছে ধর্ষণের দৃশ্যও।
গল্পে দেখা যায়, শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। তরুণ ভাস্কর শাহেদ এবং তার ছোট বোন হাসির সুখের সংসার। বাসার একটি রুমে শাহেদের স্টুডিও যেখানে তার বানানো বহু ভাস্কর্য সাজানো থাকে। একদিন হাসির পরিচিত সন্ধ্যা নামের এক তরুণী হাসিদের বাসায় এসে শাহেদের স্টুডিওতে ঢোকে এবং অসাবধানতায় একটা ছোট্ট ভাস্কর্য ভেঙে যায়। শাহেদ সন্ধ্যাকে বেশ বকে দেয়। এরপর আসে সেই ভয়াল ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি হায়েনারা হামলে পড়ে, হাসিকে মেরে ফেলে, তছনছ করে শাহেদের স্টুডিও। শাহেদ ফিরে এসে এসব দেখে নিজের জিদটা সাহসে রূপান্তর করে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে দেখা হয় মেজর মাসুদের, জানতে পারে তার বোনের নাম সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করার কারণে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। শাহেদ তার সামনে ভাস্কর্য বানায় যেটা দেখে সন্ধ্যা ভাবে এই মেয়ের সঙ্গে হয়তো শাহেদের সম্পর্ক ছিল। পরে শাহেদ জানায় তার বোন হাসির মুখের আদলে বানানো এই ভাস্কর্য। নিজেকে অপবিত্র ভেবে আত্মহত্যা করতে যায় সন্ধ্যা। মাসুদ ও শাহেদ তাকে বাঁচায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক বছর পর ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিনেমাটি মুক্তি পায়। পরিচালনা করেছেন মমতাজ আলী। এর গল্প লিখেছেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন শান্তি কুমার চট্টোপাধ্যায়। সিনেমার একটি গান ‘দাদাভাই মূর্তি বানাও’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সংগীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী। সহযোগিতায় ছিলেন আলাউদ্দীন আলী ও তার অর্কেস্ট দল। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী। সংলাপ ও চিত্রনাট্যে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও তা কাটিয়ে, যুদ্ধদিনের সিনেমা হিসাবে এটির আলাদা একটি আবেদন ছিল। সেদিক থেকে দেখলে এ সিনেমাও ইতিহাসের একটি দলিল। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি বহন করছে আজও। সিনেমায় শাহেদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা বিশ্বজিৎ এবং সন্ধ্যা চরিত্রে বাংলাদেশের কবরী। মাসুদ চরিত্রে গোলাম মুস্তাফা ও হাসি চরিত্রে রূপদান করেন সুলতানা। অন্যান্য চরিত্রে খলিল, মঞ্জু দত্ত, সরকার কবিরউদ্দিনসহ অনেকে অভিনয় করেন।
মমতাজ আলী একাধারে পরিচালক, প্রযোজক ও পরিবেশক ছিলেন। সামাজিক-অ্যাকশন ঘরানার সিনেমার জন্য তিনি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৩৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এ নির্মাতা। সিনেমার টানে বালক বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (মুম্বাই) চলে যান। সেখানকার বিভিন্ন ফিল্ম ইউনিটে কাজ করার পাশাপাশি শিশুশিল্পী হিসাবে ১০-১২টি সিনেমায়ও অভিনয় করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরে পরিচালক এ জে কারদারের সহকারী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিখ্যাত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন তিনি। এ ছাড়া লাহোর এবং ঢাকায় আরও অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন মমতাজ আলী। ‘আকাশ আর মাটি’সহ কয়েকটি সিনেমায় তিনি অভিনয়ও করেছেন। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘নতুন নামে ডাকো’ ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায়। এরপর তিনি ‘নতুন ফুলের গন্ধ’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘সোনার খেলনা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘ঈমান’, ‘কুদরত’, ‘নালিশ’, ‘নসীব’, ‘উসিলা’, ‘নিয়ত’, ‘কারণ’, ‘বিশাল’, ‘নতিজা’, ‘সোহরাব রুস্তম’সহ আরও অনেক সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তার পরিচালিত বেশির ভাগ সিনেমাই পেয়েছে ব্যবসায়িক সাফল্য। ১৯৯৭ সালের ৮ নভেম্বর মারা যান তিনি।
