গৌরব ও ঐতিহ্যের মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা
সাদ বিন হাসান
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা-এমন এক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আধুনিকতা একসঙ্গে ধারণ করে। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী, যেখানে শতাব্দী প্রাচীন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম ও উন্নতির কাহিনি বোনা আছে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটলে শুরু হয় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন। রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হতে থাকা মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে সামাজিক মর্যাদার প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এমনকি নিজেদের তাহজিব-তমদ্দুন বাঁচিয়ে রাখাই হয়ে ওঠে মুসলমানদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ কঠিন ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসেন কতিপয় মুসলিম শিক্ষাবিদ; যাদের হাতে ভিত্তি পেয়েছিল আজকের মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা। এ বিষয়ে লিখেছেন সাদ বিন হাসান
ইতিহাসের সূচনা
মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার শুরু ১৭৮০ সালে। কলকাতার বৈঠকখানা রোডে মাসিক ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চালু হয় মাদ্রাসাটি। মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে মাদ্রাসাটি পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মওলানা মজদুদ্দিন ওরফে মোল্লা মদন (রাহ.)। অবিভক্ত বাংলায় তখন ইংরেজ শাসনামল, বাংলার মুসলিম সমাজ রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর বন্ধ হওয়া, সামাজিক মর্যাদাহীনতা এবং আর্থিক সংকট এ সময় বাঙালি মুসলিমদের এক কঠিন দুরাবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ঠিক এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে, কিছু মুসলিম শিক্ষাবিদ ওয়ারেন হেস্টিংসয়ের সঙ্গে দেখা করে এক নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধন এবং মুসলমান যুবকদের জন্য সরকারি পদে নিয়োগের সুযোগ তৈরি করা। সে উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দান করতেই অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল মাদ্রাসা-ই -আলিয়ার অগ্রযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মূল অংশটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা নামে পরিচিতি লাভ করে।
ঢাকায় মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হককে। প্রথমে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ)-এর কার্যক্রম চলতে থাকে। পরে ১৯৫৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার বকশীবাজারে মাদ্রাসার নতুন ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ১৯৬১ সালে নিজস্ব ভবনে মাদ্রাসার সব কার্যক্রম শুরু হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান
মাদ্রাসা-ই-আলিয়া তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলামি শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণকে ভিত্তি করে চলেছে। এ মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই ছিল না, বরং এটি ছিল পুরো উপমহাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের এক কেন্দ্রবিন্দু, যা মুসলিম সমাজের জন্য নতুন সম্ভাবনা ও আধুনিক শিক্ষা-ঐতিহ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বর্তমানে মাদ্রাসাটির শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে ফাজিল, আলিম, ফাজিল (অনার্স) ও কামিল (মাস্টার্স) কোর্স, যা ছাত্রদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলে। ভাষা, বিজ্ঞান, কলা, সমাজকর্মসহ আরও নানা বিষয়ের ওপর এখানে শিক্ষার্থীদের উচ্চমানের শিক্ষা প্রদান করা হয়।
এশিয়ার প্রাচীনতম লাইব্রেরি
মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার লাইব্রেরি একটি যে কোনো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির মতো নয়! এটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি হিসাবে সুবিবেচিত হয়ে আসছে বহু আগে থেকে। এখানে সংরক্ষিত আছে নানা ভাষায় লেখা দুষ্প্রাপ্য বই এবং পাণ্ডুলিপি। আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নানা মূল্যবান গ্রন্থের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে, যা গবেষণায় আগ্রহী ছাত্রদের জন্য অমূল্য রত্ন। এর পাশাপাশি, রয়েছে অনেক গবেষণামূলক গ্রন্থ, যা দেশের ও বিদেশের এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। এ লাইব্রেরিতে এমনসব গ্রন্থাদিও রয়েছে যেগুলোর বয়স মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার বয়সের চেয়েও অনেক বেশি! ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সব বিষয়েই রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল দুর্লভ অনেক গ্রন্থ। ইংরেজি ও ফরাসির ধ্রুপদি সাহিত্য থেকে শুরু করে রয়েছে বাংলা এবং ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়া সমগ্র।
এই লাইব্রেরিতে এমন বেশ কিছু মৌলিক গ্রন্থ বিদ্যমান আছে যেগুলো গাণিতিক এবং দর্শন শাস্ত্রসহ আইন, যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপনকারী। যেমন : কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা (Kitab Al-Jabr w'al-Muqabala) এটি বীজগণিত (Algebra)-এর ইতিহাসে একটি মাইলফলক গ্রন্থ, যা গণিত শাস্ত্রের বিকাশে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। রয়েছে কিতাব আল-ফখরি (Kitab Al-Fakhri) কিতাব আল-মাহাজান (Kitab Al-Mahajan) কিতাব আল-হিসাব (Kitab Al-Hisab)-এর মতো গণিত ও দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কিত আরও গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি, যা প্রাচীন হিসাববিজ্ঞান ও দর্শনের গভীরতা প্রকাশ করে। রয়েছে আইন, ধর্মশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান প্রধান গ্রন্থ, যেমন ‘কিতাব আত তিব’, ‘কিতাব আল শিফা (The Book of Healing)’ আরও রয়েছে হানাফি মাজহাবের বিস্তৃত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কিতাব আল মাবসুত’ এবং হস্তলিখিত মূল বুখারি শরিফের পাণ্ডুলিপি। এখানে বিদ্যমান আছে প্রাচীন আরবি ভাষা, ফারসি ভাষা এবং উর্দু কবিতার সমৃদ্ধ সংকলন। আরও রয়েছে আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দবিজ্ঞান, ব্যাকরণ ও ধর্মতত্ত্বের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ। লাইব্রেরির এসব মূল্যবান প্রাচীন দুর্লভ গ্রন্থাদি এবং জ্ঞানের নানা বিষয়ের ওপর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নথি ও পাণ্ডুলিপিগুলো দেশি-বিদেশি গবেষকদের আকর্ষণ করে, যা হার্ভার্ডসহ অন্য দেশ ও বিদেশের গবেষক এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের আগমনের ঘটনা থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়।
প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক ভবন
মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার অ্যাকাডেমিক ভবন ও এর প্রাঙ্গণটি এক নতুন দৃষ্টিতে শিক্ষার পরিবেশ প্রদান করে। এখানে রয়েছে আধুনিক শিক্ষার সব ধরনের সুযোগ, যেমন-কম্পিউটার ল্যাব এবং বিজ্ঞানাগার, যেখানে ছাত্ররা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরের পর মাদ্রাসাটি বর্তমানে যে ভবনে অবস্থিত, তা একটি সুসংহত ও অত্যাধুনিক স্থাপত্যের উদাহরণ, মাদ্রাসা প্রাচীরের ভেতরে মূল ভবনের চারপাশে সুন্দরভাবে সাজানো বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় গাছ এবং বাহারি রঙের ফুল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রশান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি মনোরম ছাত্রাবাস ও আধুনিক মসজিদ, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ এবং শান্তিপূর্ণ করে তোলে।
চারটি সংযুক্ত ভবনের সমন্বয়ে গঠিত আল্লামা কাশগরী (রহ.) ছাত্রাবাসটি হলো মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ছাত্রদের প্রধান আবাসিক হল। হল প্রাঙ্গণে রয়েছে শহীদ মিনার এবং বাগান। সম্মুখ ভবনের নিচতলায় আছে ক্যান্টিন এবং ওপরের তলায় হলো মসজিদ। বাকি তিন পাশের ভবন ছাত্রদের বসবাসের জন্যে সুসংহতভাবে রুমভিত্তিক নম্বর দিয়ে সাজানো হয়েছে। এ আবাসিক হল ভবনটির বিপরীতে রয়েছে আলিম এবং তদনিম্ন ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত মুফতি আমীমুল ইহসান আবাসিক হল। এ হলটির সম্মুখভাগে রয়েছে মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার সুবিশাল মাদ্রাসা মাঠ। এ মাঠেই প্রতি বছর মাদ্রাসার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি এবং ছাত্রদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তোলার লক্ষ্যে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার প্রধান ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলের মধ্যবর্তী জায়গাতেই রয়েছে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের সুবিধার্থে একটি মার্কেট। যা বকশিবাজার এলাকার সর্বসাধারণের জন্যেও উন্মুক্ত। এটি ‘আলিয়া মাদ্রাসা মার্কেট’ নামে পরিচিত।
পাঠদান প্রক্রিয়া
মাদ্রাসার শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না, তারা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশক্তি জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন। বছরের শুরুতে সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়বস্তুগুলোর মাসভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং সে অনুযায়ী সিলেবাসভুক্ত বিষয়গুলোর পাঠদান সমাপ্ত করা হয়। প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর সব বিষয়ের শিক্ষকরা নিজ নিজ বিষয়ের পঠিত অংশের একটি লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করেন। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সেমিনার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এ ছাড়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে অভিভাবকদের কাছে চিঠি দিয়ে থাকেন। অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষাগ্রহণের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দ্যেশে এ ধরনের যোগাযোগ ও মতবিনিময় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবকদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেন।
প্রতি দুইমাস অন্তর একবার মাদ্রাসার অডিটোরিয়ামে শিক্ষক ও ছাত্রদের যৌথ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সমাবেশে ছাত্রদের লেখাপড়ার মান উন্নয়ন, পরীক্ষায় নকল প্রবণতার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ সুন্দরকরণ ও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলকরণ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা হয়। ক্যারিয়ার গঠন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা হয়। মাদ্রাসার কম্পিউটার ল্যাব এবং আইসিটি বিভাগ শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত করায়, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি সরবরাহ করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন যারা
নওয়াব আবদুল লতিফ
নওয়াব আব্দুল লতিফ ১৯০০ শতকের বাঙালি মুসলিম শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী। তিনি ছিলেন আধুনিক মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি তার শিক্ষাজীবনে মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইংরেজি, আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা।
সৈয়দ আমির আলী
তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় মুসলিম আইনজ্ঞ যিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক এবং লেখক। তিনি ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি বিখ্যাত বই লিখেছিলেন। তার বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘দ্য স্পিরিট অফ ইসলাম’। এ বইটিই পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতের আইনে মুসলিম আইন প্রবর্তন করার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল।
আল্লামা কাশগরী (রহ.)
আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অসাধারণ ইসলামি পণ্ডিত, ভাষাবিদ, আরবি কবি ও সাহিত্যিক। আরবি ভাষায় বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘আয-যাহরাত’ এবং অভিধান ‘আল-মুফিদ’ তার অমর কীর্তি। তিনি বাংলাদেশে আল্লামা কাশগরী নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তিনি লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামায় শিক্ষা লাভ করে হাদিস, তাফসির ও আরবি সাহিত্যে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাংলার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অনুরোধে ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং এক পর্যায়ে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানার দায়িত্বও পালন করেন।
মৌলভী আবদুল করিম
মৌলভী আব্দুল করিম ছিলেন একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও লেখক। তিনি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ছাত্র এবং কর্মজীবনের শুরুতে এ প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৮৮৯ সালে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর অব স্কুল ফর মহামেডান এডুকেশন’ পদে নিযুক্ত হন এবং পরে বিভাগীয় ‘স্কুল ইন্সপেক্টর’ পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের মধ্যে তিনি প্রথম এ পদমর্যাদার অধিকারী হন। তিনি প্রথমদিকের বাঙালি মুসলমান স্কুলপাঠ্য-পুস্তক রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম এবং তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে ‘ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত’ অন্যতম একটি বই।
সাইয়েদ আনোয়ার হুসাইন তাহির জাবেরী আল মাদানী
ইসলামি আলোচক, গবেষক, আহলে বাইতের সদস্য ও বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিনের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা তিনি। এ ছাড়া চট্টগ্রামের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব সাইয়েদ আনোয়ার হুসাইন ঢাকা আলিয়ার ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নরস সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরী
সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরি একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি ইসলামি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও লেখক। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল ডিগ্রি এবং মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআইইউ) প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং নরসিংদিস্থ জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা এবং অধ্যক্ষ। এ ছাড়া তিনি সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংক অব বাংলাদেশ এবং ‘সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইনস্যুরেন্স অব বাংলাদেশ’-এর চেয়ারম্যান এবং বিশ্ব ইসলামী স্কলারদের সংগঠন রাবেতা আলম আল ইসলামীর (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মুসলিম স্কলারস) সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য হিসাবে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ
মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন একজন অগ্রগণ্য বাঙালি সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং ইসলামী পণ্ডিত, যিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজে নবজাগরণের ক্ষেত্রে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি হলো বাংলা ভাষার প্রথম মুসলিম পরিচালিত দৈনিক সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদ’ (১৯৩৬) প্রতিষ্ঠা, যা বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণ ও পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি একজন শক্তিশালী লেখকও ছিলেন, ‘মোস্তফা চরিত’ এবং ‘মোছলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’-এর মতো গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান
মুফতি আমীমুল ইহসান নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট মুসলিম আলেম এবং লেখক ছিলেন। তিনি এ মাদ্রাসারই ছাত্র ছিলেন এবং পরে কর্মজীবনে এখানেই শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া মুফতি আমীমুল ইহসান বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রথম খতিব ছিলেন। তার বই আরব বিশ্বে ও উপমহাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সিলেবাসভুক্ত রয়েছে।
খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ একজন বাংলাদেশি ইসলামি ব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক, গবেষক, লেখক, টিভি আলোচক ও অনুবাদক ছিলেন। তিনি ইসলামিক টিভি, এনটিভি, পিস টিভি, ইত্যাদি টিভি চ্যানেলে ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইসলামের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আইটিভি ইউএস (মার্কিন ইসলামি টেলিভিশন চ্যানেল)-এর উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদিস ও ইসলামি শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তার লিখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে উশর বা ফসলের জাকাত : গুরুত্ব ও প্রয়োগ’ গ্রন্থটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সব আলিয়া মাদ্রাসায় অনার্স-এর পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত একটি বই।
প্রফেসর মোহাম্মদ ওবায়দুল হক
বর্তমান অধ্যক্ষ, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা। তিনি ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর এ পদে নিয়োগ পান। সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় যোগদানের আগে তিনি ঢাকা কলেজের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ এবং দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতার জীবনে তিনি ইসলামিক শিক্ষার প্রচার ও গবেষণায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদানের সময় তিনি শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আধুনিক শিক্ষায় সমভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি নবগঠিত মাদ্রাসা-ই-আলিয়া এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। প্রফেসর মোহাম্মদ ওবায়দুল হক এ সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ারই একজন কৃতী ছাত্র।
সাক্ষাৎকার
দুর্লভ বইগুলোকে ই-বুক করে রাখা হবে: মাহমুদা বেগম
সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার সমৃদ্ধ ও প্রাচীন গ্রন্থাগারে রয়েছে আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নানা মূল্যবান গ্রন্থের এমন এক বিশাল সংগ্রহ-যা গবেষণায় আগ্রহী ছাত্রদের জন্য অমূল্য রত্ন। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সব বিষয়েই রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল দুর্লভ গ্রন্থ। সম্প্রতি যুগান্তরের মুখোমুখি হয়েছেন এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এ গ্রন্থাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম নারী গ্রন্থাগারিক মাহমুদা বেগম
আপনি বাংলাদেশের প্রাচীনতম জ্ঞানভান্ডারের দায়িত্বে আছেন; লাইব্রেরির সঙ্গে আপনার সফর সম্পর্কে জানতে চাই।
২০১৯ সাল থেকে এখানে দায়িত্বে আছি। আমি এ ব্যাপারে গর্ববোধ করি যে উপমহাদেশের সু-প্রসিদ্ধ এবং এমন সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরিতে আমিই সর্বপ্রথম নারী লাইব্রেরিয়ান।
শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে আনাগোনা কেমন, আশানুরূপ কি?
মোটামুটি। আমি খুব বেশি বলব না, আবার খুব কমও বলব না। ছাত্ররা বিভিন্ন সময়ে আসে এবং অনেক ধরনের বইপত্র ঘেঁটে দেখে এটা সন্তোষজনক।
লাইব্রেরির ব্যাপারে সরকার বা দায়িত্বশীলদের পৃষ্ঠপোষকতা কেমন?
এ লাইব্রেরিটির ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা অত্যন্ত সচেতন। প্রতি বছর লাইব্রেরি উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট বাজেট থাকে। এ বছরও অনেক নতুন বই সংযোজিত হয়েছে। মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ওবায়দুল হক স্যার এ মাদ্রাসারই সাবেক ছাত্র; তিনি ছাত্রজীবনে এ লাইব্রেরি ব্যবহার করেছেন এবং তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন যে এখানে কী অমূল্য সম্পদ আছে! এ লাইব্রেরি তার একটি বিশেষ ভালোবাসার জায়গা। তিনি চান আলিয়া মাদ্রাসায় যত স্টুডেন্ট আছে-দাখিল, আলিম, স্নাতক, ডিগ্রি; চাই সে যে শ্রেণিরই হোক তারা যেন লাইব্রেরিতে আসে।
কোন ধরনের পাঠকদের বেশি আকর্ষণ করছে এ লাইব্রেরি?
সাধারণভাবেই এটি যেহেতু সমৃদ্ধ এবং অতি প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার-কৌতূহলবশত অনেক প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা এটা পরিদর্শনের জন্যে আসেন। তবে আমি বিশেষভাবে বলব, গবেষণার জন্যে মূলত বহির্বিশ্বের অনেক দূর-দূরান্ত থেকে বহু গবেষক শিক্ষার্থীরা এখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিসার্চের জন্যে আসেন এবং অনেকেই লম্বা সময়ের জন্যেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এখানে গবেষণামূলক কাজ বা পড়াশোনা করে থাকেন।
লাইব্রেরির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
লাইব্রেরিটিতে বর্তমানে পঁচিশ থেকে প্রায় তিরিশ হাজার বই রয়েছে।
ছাত্র কিংবা গবেষকরা লাইব্রেরির প্রাচীন গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা অনুভব করে কিনা?
না। এ ব্যাপারে গবেষকরা সেরকম কোনো অনুযোগ কিংবা অভিযোগ আমাদের করেননি। ওনারা আসেন নিজেদের মতো করে প্রয়োজনীয় বই খোঁজেন এবং কখনো কোনো ডকুমেন্টসের জন্যে এসে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্ত পাননি এরকম অভিযোগও আমরা এখনো পাইনি। বরং বরাবরই তারা সন্তুষ্ট হন আর প্রিন্সিপাল স্যারের কাছেও তাদের সন্তুষ্টির কথা বলে যান।
যেহেতু এটি এশিয়ার মধ্যে একটি প্রাচীনতম লাইব্রেরি, এখানে এমন অনেক বই হয়তো আছে যা আর কোথাও নেই; তো সেখান থেকে প্রাচীন বইপত্রগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আপনাদের উদ্যোগ কী?
বই পুরোনো হলে আসলে ধীরে ধীরে তা নষ্ট হবেই। আর তাই, প্রিন্সিপাল স্যার লাইব্রেরির আধুনিকায়ন এবং অতি প্রাচীন গ্রন্থগুলো সংরক্ষণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে বইগুলো অত্যন্ত দুর্লভ কিংবা যেগুলো খুব বেশি প্রয়োজন এমনসব বইগুলো ই-বুক করে রাখা হবে। ইতোমধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে সুপারিশ আদায় করেছেন।
মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার লাইব্রেরি এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডার
মাদ্রাসা-ই আলিয়ার লাইব্রেরি একটি যে কোনো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির মতো নয়! এ লাইব্রেরিটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি হিসাবে সুবিবেচিত হয়ে আসছে বহু আগে থেকে। এখানে সংরক্ষিত আছে নানা ভাষায় লেখা দুষ্প্রাপ্য বই এবং পাণ্ডুলিপি। আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নানা মূল্যবান গ্রন্থের এমন এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এই লাইব্রেরিতে, যা গবেষণায় আগ্রহী ছাত্রদের জন্য অমূল্য রত্ন। এর পাশাপাশি এখানে রয়েছে অনেক গবেষণালব্ধ দুর্লভ গ্রন্থ যা এ লাইব্রেরিকে করে তুলেছে দেশ ও বিদেশের এম.ফিল ও পিএইচ.ডি গবেষকদের জন্য এক আদর্শ স্থান। এই লাইব্রেরিতে এমন কিছু গ্রন্থাদিও রয়েছে যেগুলোর বয়স মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার বয়সের চেয়েও অনেক বেশি! ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সব বিষয়েই রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল দুর্লভ গ্রন্থ। ইংরেজি ও ফরাসির ধ্রুপদি সাহিত্য থেকে শুরু করে রয়েছে আরবি, বাংলা এবং ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়া তথা বিশ্বকোষ সমগ্র।
এই লাইব্রেরিতে বেশ কিছু মৌলিক গ্রন্থ বিদ্যমান আছে যেগুলো গাণিত এবং দর্শন শাস্ত্রসহ আইন, যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপনকারী গ্রন্থাদি। যেমন : কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা (Kitab al-Jabr woal-Muqabala) এটি বীজগণিত (Algebra)-এর ইতিহাসে একটি মাইলফলক গ্রন্থ, যা গণিত শাস্ত্রের বিকাশে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। রয়েছে কিতাব আল-ফখরি (Kitab al-Fakhri) কিতাব আল-মাহাজান (Kitab al-Mahajan) কিতাব আল-হিসাব (Kitab al-Hisab)-এর মতো গণিত ও দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কিত আরও গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদী যা প্রাচীন হিসাববিজ্ঞান ও দর্শনের গভীরতা প্রকাশ করে। রয়েছে আইন, ধর্মশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান প্রধান গ্রন্থ, যেমন কিতাব আত তিব, কিতাব আল শিফা (The Book of Healing) আরও রয়েছে সর্ববৃহৎ মাজহাব হানাফি মাজহাবের বিস্তৃত ব্যাখ্যাগ্রন্থ কিতাব আল মাবসুত এবং হস্তলিখিত মূল বুখারি শরিফের পাণ্ডুলিপি। এখানে বিদ্যমান আছে প্রাচীন আরবি ভাষা, ফারসি ভাষা এবং উর্দু কাবিতার সমৃদ্ধ সংকলন। আরও রয়েছে আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দবিজ্ঞান, ব্যাকরণ ও ধর্মতত্ত্বের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থা। রয়েছে ‘ডগলাস’ রচিত (১৮৯৫) কনফুসিয়ানিজম (Confucianism)-এর মতো প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চীনা দর্শনশাস্ত্রের বই। রয়েছে দিল্লি দরবারের স্মরণিকা গ্রন্থ ‘ইয়াদগার দারবার তাজপোশি’ (Memoir of the Delhi Durbar) আরও আছে পারস্যের মহাকবি ‘আবুল কাসেম ফেরদৌসী’ কর্তৃক লিখিত বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ মহাকাব্য শাহনামা। এখানে আছে আহমদ শাওকী রচিত আরবি কাব্যগ্রন্থ ‘আশ-শাওকিয়্যাত’-এর প্রাচীন সংকলন। আহমদ শাওকী যিনি ছিলেন আধুনিক আরবি সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি কবি, যাকে ‘আমিরুশ শুআরা’ বা ‘কবিদের যুবরাজ’ বলা হয়ে থাকে। লাইব্রেরিটিতে আরও আছে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু সংবলিত আরবি উর্দু-ফার্সি ভাষার ‘মার্সিয়া’ বা শোকগাথা এবং ‘আর-রুবাইয়াত’ বা চতুর্পদী কবিতার মতো প্রাচীন কাব্য সাহিত্যের নিদর্শন।
লাইব্রেরির এসব মূল্যবান প্রাচীন দুর্লভ গ্রন্থাদি এবং জ্ঞানের নানাবিধ বিষয়ের ওপর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নথি ও পাণ্ডুলিপিগুলো দেশি-বিদেশি গবেষকদের আকর্ষণ করে, যা হার্ভার্ডসহ অন্যান্য দেশ ও বিদেশের গবেষক এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের আগমনের ঘটনা থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়।
