Logo
Logo
×

ক্যাম্পাস তারুণ্য

কারিগরি শিক্ষা

সাফল্যের শিখরে ওঠার সিঁড়ি

Icon

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা কেবল জ্ঞানের আলো নয়, এটি জাতির অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি। সেই আলোর এক কার্যকর ও বাস্তবধর্মী রূপ হলো কারিগরি শিক্ষা-যেখানে মেধার সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষতার অনুশীলন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন পুনর্গঠনের সংগ্রামে নিমগ্ন, তখনই জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে উঠে আসে এক নতুন দিশা; হাতে-কলমে শেখার এ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার ময়দানে টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত হয়ে ওঠে দক্ষ জনশক্তি গঠন।

বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার গৌরব ও সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেছেন শরীফুল ইসলাম

ইতিহাসের পথ বেয়ে বর্তমান

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে; মূলত ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ও কারিগরি চাহিদা মেটাতে। ১৮৭৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল-যা পরে আজকের ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। তবে কারিগরি শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন হয় পাকিস্তান আমলে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যা ১৯৬৯ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর এ বোর্ড ‘বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি)’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করা হলেও, সাধারণ শিক্ষার তুলনায় এটি বরাবরই কিছুটা অবহেলিত ছিল। প্রথম দিকে সামাজিক অবমূল্যায়ন ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি নীতিগত সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলে এ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। শিল্পায়নের প্রসার ও বিদেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে প্রণীত জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি (এনএসডিপি) এবং ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল কোয়ালিফিকেশনস ফ্রেমওয়ার্ক (এনটিভিকিউএফ) কারিগরি শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১১,১১৮টি; এর মধ্যে সরকারি ৭৭৭টি এবং বেসরকারি ১০,৩৪১টি। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখেরও বেশি।

শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা

প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা আজ বাংলাদেশের একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। হাতে-কলমে বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হয়। এর ফলে প্রথাগত শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরাও দক্ষতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পায়। কারিগরি শিক্ষা বেকারত্ব হ্রাসে এবং শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজগুলো এ শিক্ষা বিস্তারে নিরলসভাবে কাজ করছে।

জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো দক্ষ মানবসম্পদ, আর কারিগরি শিক্ষা সেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে। সেবা, কৃষি ও শিল্প খাতে দক্ষ কর্মী সরবরাহের মাধ্যমে এটি দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলছে। বিদেশে কর্মরত দক্ষ শ্রমিকরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় রিজার্ভে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব, আধুনিক সরঞ্জামের ঘাটতি এবং সামাজিক মানসিকতা এখনো চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।

ক্যারিয়ার সম্ভাবনা

কারিগরি শিক্ষায় রয়েছে বহুমুখী স্বপ্নের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। চাকরির জন্য রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত ক্ষেত্র। যেমন-ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সবচেয়ে বড় কর্মক্ষেত্র হলো সরকারি ইপিজেডগুলো ও গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। এ ছাড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, সয়েল টেস্ট ফার্ম, কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, হাই ভোল্টেজ কেবল লাইন ও পাওয়ার জেনারেটর প্লান্ট-সবখানেই প্রয়োজন যোগ্য কারিগরি শিক্ষিত কর্মীর। শুধু তাই নয়, হাউস ওয়্যারিং, শিল্প-কলকারখানা, স্ট্রাকচার ডিজাইন ফার্ম, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অ্যান্ড ডিজাইন হাউস, এমনকি গ্রাফিক ডিজাইন ও কম্পিউটার হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ফার্ম পর্যন্ত এখন ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থীদের জন্য সম্ভাবনাময় পেশাক্ষেত্র তৈরি করছে। ই-কম্পিউটার ডিজাইনার, ডেটা ও মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন ইনস্টিটিউটগুলোতেও তারা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন।

বস্ত্র ও পোশাক শিল্পেও এ শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। দেশের টেক্সটাইল মিল, গার্মেন্টস কারখানা ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয় দক্ষ কারিগরি কর্মীর। একইভাবে গ্লাস ও সিরামিক শিল্প, পল্লি বিদ্যুৎ, ডেসকো, আইডিবি, বিটিসিএল, মেডিকেল ল্যাব, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও ওষুধ কোম্পানিসহ দেশ-বিদেশের শত শত প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বহুমাত্রিক ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সুযোগ। মোট কথা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার থাকার আশঙ্কা খুব কম। পড়াশোনা শেষ করেই রয়েছে চাকরির নিশ্চয়তা ও সফল ক্যারিয়ারের হাতছানি।

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের জন্য কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখা অসম্ভব। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং রোবটিক্সয়ের মতো প্রযুক্তিগুলো যখন প্রচলিত চাকরির বাজারকে সংকুচিত করছে, তখন নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক পেশায় টিকে থাকতে হলে কারিগরি দক্ষ কর্মীর বিকল্প থাকবে না। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, যা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ হিসাবে পরিচিত। এ তরুণ জনগোষ্ঠীকে যদি সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করা যায়, তবে তারা দেশের জন্য বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।

দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এ দক্ষ জনশক্তি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। বর্তমানে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে যারা বিদেশে যান, তাদের তুলনায় একজন দক্ষ টেকনিশিয়ানের আয় বহুগুণ বেশি। এর মাধ্যমে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। পাশাপাশি, কারিগরি শিক্ষা আত্মকর্মসংস্থান তৈরিতেও সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একজন ডিপ্লোমাধারী বা দক্ষ টেকনিশিয়ান অন্যের অধীনে চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজেই একটি ছোট ওয়ার্কশপ বা সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন, যা আরও কয়েকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

পাঠদান প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠানে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। যেমন-প্রকৌশল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজ ইত্যাদি। কারিগরি শিক্ষার পাঠদান প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে উচ্চতর প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পান। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাঅধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের একটি অধিদপ্তর। এর মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। অধিদপ্তরাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত তিনটি স্তরে পাঠদান পরিচালনা করে- সার্টিফিকেট স্তর, ডিপ্লোমা স্তর, ডিগ্রি স্তর।

সার্টিফিকেট পর্যায়ে রয়েছে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সের মাধ্যমে প্রাথমিক কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে। পরবর্তী ধাপে ডিপ্লোমা পর্যায়ে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পরিচালনা করে। এ স্তরে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি, শিল্প, নির্মাণ ও উৎপাদন খাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে হয়ে ওঠে দক্ষ মানবসম্পদ। সবশেষে ডিগ্রি স্তরে রয়েছে টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যেখানে উচ্চতর প্রযুক্তি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, প্রকৌশলবিদ্যা ও গবেষণাধর্মী পাঠ্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়ন সম্ভব হয়। এর বাইরেও কারিগরি শিক্ষার আওতায় রয়েছে এইচএসসি (ভোকেশনাল/ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) এবং স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স, যা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা ও আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়।

সুতরাং, কারিগরি শিক্ষা আজ বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তি। দক্ষতা, কর্মসংস্থান ও উদ্ভাবনের সমন্বয়ে এটি শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, বদলে দিচ্ছে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম