হাতীবান্ধা ওসির লক্ষ্য মামলা বাণিজ্য
আদালতে মামলা করিয়ে ফের থানায়ও নিলেন

মিজানুর রহমান দুলাল, লালমনিরহাট
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আদালতের নির্দেশও তোয়াক্কা করছেন না হাতীবান্ধা থানার সেই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুন-নবী। ফলে তার বেপরোয়া ‘মামলা বাণিজ্যের’ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মানুষজন। সম্প্রতি ঘটনার ৭ মাস ২২ দিন পর দায়েরকৃত একটি মামলায় আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে বাদীর ওপর হামলার ঘটনায় কৃষক দলের দুই নেতাসহ নিরীহ মানুষজনকে আসামি করার বিষয়ে সমালোচনায় পড়েন ওসি। এ নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওসির বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে মানববন্ধন-সমাবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে খোদ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ‘ওসির পরামর্শে’ একই মামলা দুই জায়গায় : আদালত ও থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের একটি ঘটনা নিয়ে মোতাহার হোসেন মিন্টু নামের এক যুবদল নেতা গত বছরের ১২ নভেম্বর মামলা করতে থানায় যান। তবে ‘ওসির পরামর্শে’ পরবর্তীতে তিনি আদালতের আশ্রয় নেন। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন হাতীবান্ধা থানার ওসিকে। কিন্তু তিনি প্রায় সাড়ে তিন মাসেও আদালতে প্রতিবেদন জমা দেননি। উলটো একই ঘটনায় বাদীকে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া ওসি নতুন করে থানায় নিয়মিত মামলা নথিভুক্ত করেছেন। ওই ঘটনায় আদালতে দেওয়া অভিযোগে বাদী ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করলেও থানায় দায়ের করা মামলায় ১০২ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে।
গত বছরের ১৭ নভেম্বর আদালতে মোতাহার হোসেন মিন্টু ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার জেরে ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট নিজের বাড়িতে হামলার শিকার হন বাদী মোতাহার হোসেন মিন্টু। এতে উল্লেখিত আসামিরা ছাড়াও অজ্ঞাত প্রায় আরও ৪০ জন অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশনা না মেনে প্রায় সাড়ে তিন মাসেও সেই প্রতিবেদন জমা দেননি ওসি। উলটো গত ৩ মার্চ একই ঘটনায় নতুন করে মোতাহার হোসেন মিন্টুর দেওয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিয়মিত মামলা নথিভুক্ত করেন।
আদালতের চেয়ে থানার মামলায় আসামি দ্বিগুণ : থানায় দায়ের মামলার এজাহারে দেখা যায় ১০২ জনের নাম উল্লেখসহ প্রায় ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালতে মামলায় উল্লেখিত ৪৭ জনের পাশাপাশি থানার মামলায় নতুন করে ৫৫ জনকে আসামি হিসাবে দেখানো হয়েছে। এজাহারে ঘটনার তারিখ ও সময় একই রয়েছে।
জানতে চাইলে লালমনিরহাটের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজুল হক দুলাল যুগান্তরকে বলেন, আদালতে বাদি মিন্টু ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে যে মামলাটি করেছিলেন সেটি তদন্তের জন্য হাতীবান্ধার ওসির কাছে পাঠিয়েছিলেন। যার পিটিশন নম্বর-৪৩৬। ওসি আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই একই ঘটনায় মামলা নিয়েছেন। জানা গেছে, দুটি মামলাতেই আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এর বাইরেও অনেক নিরীহ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে শিক্ষক ও অনেকে ব্যবসায়ীও রয়েছেন। সেই সঙ্গে কেউ কেউ কোনো প্রকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
‘আহত’ বাদীর দুটি এজাহারে দুই রকম তথ্য : আদালত ও থানায় দায়ের করা এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুটি আবেদনেই ঘটনার তারিখ, সময় ও স্থান একই উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতে দায়ের মামলায় নগদ আড়াই লাখ টাকা ও বাছুরসহ ১৩টি গরু লুটের অভিযোগ করা হয়েছে। তবে থানায় নথিভুক্ত মামলার এজাহারে নগদ চার লাখ টাকা, বাছুরসহ ১১টি গরু, স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য জিনিস লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুই এজাহারেই কয়েকজন আসামির ক্রম ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনার সময় ‘আহত’ বাদী হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে দুটি এজাহারে দুই রকম তথ্য উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে বাদী মোতাহার হোসেন মিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ৩ মার্চ থানায় মামলা নথিভুক্ত হওয়ার পর একজনের সঙ্গে বাদীর কথপোকথনের অডিও ক্লিপ যুগান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে বাদী মুঠোফোনে অপরজনকে বলছেন ‘হ্যাঁ মামলা রেকর্ড হয়েছে। ওসি স্যারের কথা হ্যাঁ, মিন্টু সাহেব এখন যা কইবে (বলবেন) ওইটাই (ওটা) আইন।’
জানতে চাইলে হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক ও ইউপি সদস্য আমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আদালত মামলা তদন্ত করার জন্য ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। উলটো তিনি ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে সাড়ে তিন মাস পর আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে মামলা নিলেন। এতেই বোঝা যায়, তিনি যেমন আদালতের নির্দেশ মানছেন না; তেমনি মূল অপরাধীদের আড়াল করে নিরীহ মানুষজনকে ফাঁসিয়ে মামলা বাণিজ্য করছেন। যা প্রতিনিয়ত পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষতি করছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে হাতীবান্ধা থানার ওসি মাহমুদুন-নবী সাংবাদিকদের বলেন, দুটি মামলার একটি বাতিল হবে। এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।