Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আলোচনা সভায় তারেক রহমান

হুমকি না দিয়ে নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হোন

কিছু দল সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে * গণভোটের চেয়ে জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হুমকি না দিয়ে নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হোন

কিছু রাজনৈতিক দল সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, কিছু দল দুর্বল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এসব না করে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের সরাসরি ভোটে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র যখন প্রস্তুত হচ্ছে, তখন কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধিকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, নিজ নিজ দলীয় সমর্থক নেতাকর্মীদের বাইরেও কিন্তু অরাজনৈতিক কিংবা নির্দলীয় এক বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছেন।

বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির উদ্যোগে এই আলোচনা সভায় জামায়াতসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতা অংশ নেন। তাদের কারও কারও বক্তব্যে চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জাতীয় ঐক্য গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা শর্ত দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করেই রাষ্ট্রযন্ত্রে খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা। অন্যদিকে পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা। পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগীরা গত কয়েকদিন রাজধানীতে যেভাবে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্ক বার্তা হতে পারে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একটি দল, ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ফ্যাসিবাদীদের ছাতার নিচে আশ্রয় নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচার একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলটির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে কিনা এ ব্যাপারে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেন, গণভোটের আড়ালে পতিত পরাজিত পলাতক অপশক্তিকে রাষ্ট্র রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা, এ ব্যাপারেও জনগণকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বল্পমেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণ সব ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা আশা করে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্বও নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে তারেক রহমান বলেন, দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করবে? নাকি গণতন্ত্রকামী জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেবে।

রাজপথের আন্দোলন সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সংবিধানে লেখা থাকলেই সবকিছু নিশ্চিত হয়ে যায় না। সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র রাজনীতি সম্পর্কে মোনাফেকি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা। সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য রক্ষায় বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে বলেও দাবি করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি অধিকাংশ পয়েন্টেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। জুলাই সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে বিএনপি এসব অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রাজনৈতিক দলগুলোকে অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছে তাই আদায় করে নিতে চায় কিংবা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিনা সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, প্রচলিত রাজনীতির গুণগত সংস্কার চাইলে পুঁথিগত সংস্কারের চেয়ে জননিরাপত্তার বিষয়গুলো জনগণের জীবনঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের কর্মপরিকল্পনায় আরও গুরুত্ব পাওয়া দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার আরও অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার।

গণভোটের চেয়ে জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ : দেশে এবার ১ কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আলু উৎপাদন করে কৃষকরা মনে হয় বিপাকে পড়েছেন। কারণ আলুর উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদিত আলু হিমঘরে রাখতে প্রতিকেজি আলুর পেছনে খরচ পড়ছে প্রায় ২৫ থেকে ২৭ টাকা। অথচ আলুচাষিরা এখন অর্ধেক দামেও উৎপাদিত আলু বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। আলু চাষ করে আলুচাষিরা এবার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।

তিনি বলেন, অপরদিকে আমরা যদি দেখি দু-একটি রাজনৈতিক দলের আবদার মেটাতে কথিত অকারণ গণভোট করতে হলেও রাষ্ট্রকে প্রায় সমপরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখোমুখি এসব আলুচাষির কাছে এই সময়ে ‘গণভোটে’র চেয়ে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। দেশে চাহিদার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের সক্ষমতা কৃষকদের রয়েছে। তারা যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদনও করছেন। তবে দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমার কাছে মনে হয়, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কথিত ‘গণভোট উৎপাদনের’ চেয়ে সেই টাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপন কৃষকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ভুক্তভোগী কৃষকদের বলার জায়গা কোথায়?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে দেশে গার্মেন্টশিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। এত সংখ্যক নারী যদি আট ঘণ্টার পরিবর্তে ৫ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয় তাহলে তাদের বাকি কর্মঘণ্টার টাকা কে দেবে? নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে কিনা? দেশের নারী সমাজের মধ্যে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী নারীদের মনে ছড়িয়ে পড়া চাকরি সংকোচনের আতঙ্ক কাটানো এই মুহূর্তে কথিত ‘গণভোটে’র চেয়ে বেশি দরকার।

তিনি আরও বলেন, গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ২০২৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হার ছিল সর্বনিম্ন। অন্যদিকে পরীক্ষায় দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাশ করতে পারেনি। একটি দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে পাশ করতে পারেনি। আমি মনে করি, বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা-দীক্ষায় টিকে থাকতে হলে আমাদের ‘তথাকথিত গণভোট’ নিয়ে গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে গবেষণা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া সভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণঅধিকার পরিষদ সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বিরাজমান সংকটকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি মনে করি, এই সংকট তৈরি করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের যে পথ, সেই পথকে বাধাগ্রস্ত করা; বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে সংস্কারের জন্য যে নির্বাচন হওয়া দরকার, সেই নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা এবং জনগণের ভবিষ্যৎকে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলা।’

কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংস্কার শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনি সম্পন্ন করতে পারেননি। তারেক রহমানকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনার আব্বা-আম্মা যেখানে শেষ করেছেন, আপনি সেখান থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়ে যান। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সাহায্য করব।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য ঐক্য প্রয়োজন। ঐক্য যখন থাকবে, তখনই ফ্যাসিবাদ পরাজিত হবে, স্বৈরশাসক পরাজিত হবে। আমরা সেই উদাত্ত আহ্বান জানাতে চাই-আমরা দলীয় রাজনীতি করব, আমাদের ভিন্নমত থাকবে, ভিন্ন রাজনীতি থাকবে, আমি ভিন্ন কৌশল (টেকনিক) নিয়ে চলব, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও গণতন্ত্রকে পূর্ণতা দেয়।

সমঝোতা প্রস্তাব দিয়ে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে বিএনপি জোট ও জামায়াত জোট সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেবেন। বাকি ১৫০ আসন থাকবে উন্মুক্ত। যে ১৫০ আসনে? সমঝোতা হবে তাতে বিএনপি জোট ১০০ আসনে এবং জামায়াত জোট ৫০ আসনে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেবেন। বাকি ১৫০ আসনে সবাই সবার মতো করে প্রার্থী দেবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম