জিডি করার পরও শেষ রক্ষা হলো না
রাজশাহীতে বাসায় ঢুকে বিচারকের ছেলেকে হত্যা
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আবদুর রহমানের বাসায় ঢুকে তার স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এক দুর্বৃত্ত। বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে মহানগরীর রাজপাড়া থানার ডাবতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় স্কুলছাত্র তাওসিফ রহমান সুমনকে (১৫) হত্যা করা হয়। এ সময় জজের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি আহত হন। হামলাকারী লিমন মিয়াও আহত হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তারা চিকিৎসাধীন। বিচারক আবদুর রহমানের বাসভবনে এ মর্মান্তিক ঘটনায় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
রাজপাড়ার স্পার্ক ভিউ বহুতল ভবনের কেয়ারটেকার মেসের আলী জানান, কিছু দিন আগে বিচারক আবদুর রহমান এ ভবনের পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ফ্ল্যাটে তিনি স্ত্রী লুসি ও ছেলে সুমনকে নিয়ে থাকেন। দুপুর আড়াইটার পর জজের ভাই পরিচয়ে লিমন মিয়া ফ্ল্যাটটিতে যেতে চান। বিচারকের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাকে ফ্ল্যাটে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এর আগে নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর লিখিয়ে নেওয়া হয়। এর ৩০ মিনিট পর ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী এসে জানায় বিচারকের ছেলে ও স্ত্রীকে আগন্তুক লিমন কুপিয়ে আহত করেছে। এরপর ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সুমন, তার মা লুসি ও হামলাকারী লিমনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন। সুমন রাজশাহী গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। বিচারক আবদুর রহমান গাইবান্ধা থেকে বদলি হয়ে ২৯ অক্টোবর রাজশাহীতে এসেছেন। তার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলায়। বিচারকের মেয়ে সিলেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় সুমনের লাশ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি ও হামলাকারী লিমনকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে বিচারক আবদুর রহমান ও তার সহকর্মীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান।
রামেক হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস জানান, ধারালো অস্ত্রের গুরুতর আঘাতের ফলে সুমনের মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত পাওয়া গেছে। বিচারকের স্ত্রীর ডান হাত ও উরু এবং বাঁ বাহুতে গুরুতর জখম দেখা গেছে। তার ডান হাতের একটি রগ কেটে গেছে। চিকিৎসকদের একটি সমন্বিত দল তার অস্ত্রোপচার করেছেন। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। তিনি আরও জানান, লিমন মিয়ার ডান হাতে জখম হয়েছে। তবে সেটি গুরুতর নয়।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে-বিচারকের পূর্বপরিচিত ঘাতক লিমন। লিমনের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানার মদনেরপাড় গ্রামে। তার বাবার নাম সোলাইমান শহিদ। লিমন পেশায় চালক। তার পকেট থেকে বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে।
লিমন মিয়া সম্পর্কে ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, লিমন সেনাবাহিনীতে সিপাহি পদে চাকরি করতেন। সাত থেকে আট বছর আগে তাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। তবে লিমন এলাকায় বলতেন, তিনি চাকরি ছেড়ে এসেছেন। লিমন কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার বাবা এইচএম সোলাইমান শহিদ ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। লিমন এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। ওসি জানান, লিমনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে থানায় কোনো মামলা নেই।
বিচারক আবদুর রহমানের শ্বশুরবাড়িও গাইবান্ধা জেলায়। গাইবান্ধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ছিলেন তিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণে বিচারকের স্ত্রীর সঙ্গে লিমনের পরিচয় ঘটে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় লিমনকে মাঝেমধ্যে আর্থিক সাহায্য করতেন বিচারকের স্ত্রী। ঘনিষ্ঠতা হওয়ায় লিমন আরও টাকা দাবি করে। তবে এতে লিমনের ওপর বিচারকের পরিবার বিরক্ত হয়। চাহিদামতো টাকা না পেলে ফোন করে হুমকি দিত লিমন। বলত টাকা না দিলে পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হবে। তার হুমকিতে পরিবারের সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। ৬ নভেম্বর বিচারকের স্ত্রী লুসির কাছে লিমন মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে ফোন করেন। টাকা না পেয়ে ফোনে লিমন তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। বিচারকের মেয়ের ফেসবুক মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়ে পরিবারের সবাইকে সে হত্যার হুমকি দেয়। ওই সময় সিলেটে মেয়ের সঙ্গে লুসি ছিলেন। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগরীর জালালাবাদ থানায় লিমনের বিরুদ্ধে তিনি সাধারণ ডায়েরি করেন। (ডায়েরি নং-৩৯৭ তাং-৬/১১/২০২৫)। তিন দিন আগে সিলেট থেকে লুসি রাজশাহীতে আসেন। সিলেটের জালালাবাদ থানায় করা জিডির একটি কপি তিনি বুধবার (১২ নভেম্বর) রাজশাহী মহানগর পুলিশের রাজপাড়া থানায় জমা দেন।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান জানান, সিলেটের করা জিডির কপিটি আমাদের দেওয়া হলেও তাৎক্ষণিক কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছিল-যখন তারা বলবেন তখন পুলিশ যেন ব্যবস্থা নেয়। এরইমধ্যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, বিচারকের স্ত্রী সুস্থ হলে সব জানা যাবে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। লিমনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা পুলিশকে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে। ভবনের কেয়ারটেকার মেসের আলী ও ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
বৃহস্পতিবার এক শোকবার্তায় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের একজন সদস্যের পরিবারের ওপর এ ধরনের নৃশংস আক্রমণ নিন্দনীয়, অমানবিক ও গভীরভাবে বেদনাদায়ক। এদিকে, প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় সুপ্রিমকোর্ট ঘটনাটির অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে একটি যথাযথ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিচারক আবদুর রহমানের ছেলে তাওসিফ রহমানকে (সুমন) হত্যা এবং স্ত্রী তাসমিন নাহার গুরুতরভাবে আহত হওয়ার ঘটনায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনার পরপরই আইন উপদেষ্টা সব অপরাধীকে গ্রেফতার ও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। আহত তাসমিন নাহারের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বিচারকপুত্র খুনের ঘটনার সূত্রপাত সিলেট থেকে : সিলেট ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে বিচারকপুত্র খুনের ঘটনার সূত্রপাত সিলেট নগরী থেকে। জিডির কথা স্বীকার করে সিলেটের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মোহাম্মদ মবশ্বির আলী যুগান্তরকে বলেন, বিচারকপুত্র খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ইমন ওরফে লিমন বহিষ্কৃত সেনা সদস্য। খুনের আগে সিলেটে এ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। এসবের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ খুনের ঘটনা ঘটল। তিনি জানান, ইমন দীর্ঘদিন ধরে বিরক্ত করে আসছিল জজ সাহেবের স্ত্রীকে। টাকার দরকার হলেই ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করত। ওসি বলেন, ম্যাডাম সিলেট আসার খবর পেয়ে ওই যুবকও সিলেটে আসে ও পথে-ঘাটে বিরক্ত করতে থাকে। ওই ঘটনায় জিডি হয়। পুলিশ আরও জানায়, গত ৫ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত ইমন ওরফে লিমনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছিল। তখন বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসিকে মামলা করতে বলা হলেও তিনি রাজি হননি। ফলে পুলিশ সন্দেহভাজন দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করলে সে জামিনে বের হয়ে যায়। পরে চলে যায় রাজশাহীতে ও খুনের ঘটনা ঘটায়। পুলিশ আরও জানায়, এরও আগে গত ৪ নভেম্বর সিলেট নগরীর আম্বরখানায় বিচারকের স্ত্রীকে হেনস্তা করে ইমন। এ ঘটনার পরদিন শাবির শিক্ষার্থীরা ইমনকে আটক করে। শাবির শিক্ষার্থীরা জানান, বিচারকের কন্যা তাদের সহপাঠী। তাকে দেখতে বিচারকের স্ত্রী প্রায়ই ক্যাম্পাসে আসতেন। আর এমন খবর পেলেই পিছু নিত ইমন। ক্যাম্পাসে, পথে-ঘাটে ঝামেলার সৃষ্টি করত। মেয়ের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী নয়াবাজারে। সেখানে গিয়েও ডিস্টার্ব করত ইমন। এ খবর পাওয়ার পর তারা ইমনকে আটক করে পুলিশে দেয়।
