Logo
Logo
×

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা

রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ

Icon

আমিরুল ইসলাম কাগজী

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিগত শতকে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে নির্মোহভাবে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই সামনে আসবে ২৬ মার্চ। কেন সেটা ৭ মার্চ কিংবা ২৫ মার্চ হলো না?

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। খুবই স্বাভাবিক কারণে সরকার গঠন করার কথা আওয়ামী লীগের এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা শেখ মুজিবুর রহমানের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো চক্রান্ত করে ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই পথকে করেছে রুদ্ধ। ঢাকায় জাতীয় পরিষদ সভা ডেকে বারবার স্থগিত করা হচ্ছে।

অবশেষে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছলেন ১৫ মার্চ। পরের দিন ১৬ মার্চ তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করলেন। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চ ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে সামরিক আইন প্রত্যাহারে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ইয়াহিয়া খান জানালেন সেখানে আইনগত জটিলতা রয়েছে। এ বিষয়ে লে. জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে কথা বলার জন্য বললেন। শেখ মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগের একটি টিম গঠন করা হলো, যারা পীরজাদার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। টিমে থাকলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। অপরদিকে ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের মধ্যে থাকলেন জেনারেল পীরজাদা, বিচারপতি কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান। দুপক্ষের এ দুই টিম একদিন পরপর বৈঠকে বসেছে এবং এটি আপস ফরমুলার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বের করার চেষ্টা করেছে। সে সময় পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হাসান জহির তার লেখা ‘সেপারেশন অব পাকিস্তান’ গ্রন্থে বলেন, ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিদিন সেনানিবাসে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আলোচনার নাম করে একদিকে শেখ মুজিবকে ব্যস্ত রাখতেন আর তিনি ২৫ মার্চ রাতের বেলা ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর কীভাবে সশস্ত্র হামলা চালানো যায়, তার একটি নীলনকশা তৈরি করছিলেন। প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে সৈন্য আমদানি করা হতো। এ খবর সেনানিবাস থেকে বাঙালি সৈন্যরা নিয়মিত ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। তৎকালীন বিমানবাহিনীর অফিসার এ কে খন্দকারের লেখা ‘৭১ ভেতরে বাইরে’ এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ২৫ মার্চ একেবারে সন্ধ্যাবেলা একজন রিকশাওয়ালা দৌড়াতে ৩২ নম্বরে গিয়ে একজনের হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল আজ রাতেই ঢাকা শহরে সেনাবাহিনী নামবে। সন্ধ্যা থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে শেখ মুজিবের সঙ্গে লাগাতার বৈঠক করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেনসহ নেতারা। ইয়াহিয়া খান এককভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছেন এটা বুঝতে পেরে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের ওপরে বেশি পীড়াপীড়ি করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেয়নি কোনো প্রস্তুতি। ২৭ মার্চ সারা দেশে হরতাল ডাক দিয়ে শেখ মুজিব সবাইকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার জন্য আহ্বান জানালেন। অথচ একই সময়ে চট্টগ্রামে বাঙালি সেনাদের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে এক তুমুল উত্তেজনা। যাদের রাজনৈতিক চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই, যারা শুধু গুলি চালানোর ক্ষেত্রে ওস্তাদ। তারাই ঘুরে দাঁড়াল। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে যখন ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাক হানাদার বাহিনী গুলি চালিয়ে ম্যাসাকার করল, তখন ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (রাত ২.১৫টায়) চট্টগ্রামে তরুণ সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণা করলেন উই রিভোল্ট। পাকসেনাদের বিরুদ্ধে শুরু করেন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। পরের দিন ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সকণ্ঠে ঘোষণা দেন মহান স্বাধীনতার।

স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান বসে থাকেননি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে যুদ্ধ করেছেন। শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। ৪ এপ্রিল সিলেটে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বসে তৎকালীন সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করে গোটা বাংলাদেশকে চারটি বিভাগে ভাগ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কর্নেল এমএজি ওসমানীকে ওই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। তখনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনোরকম সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়। শেখ মুজিব আগেভাগেই অর্থাৎ ২৫ মার্চ পাকহানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের চলে যান। সেখানেই ছিলেন তিনি যুদ্ধের নয় মাস। শেখ হাসিনা যে বলে থাকেন আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন কিন্তু বাস্তবতা হলো শেখ মুজিব যুদ্ধের কোনো খবরই রাখেননি। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সেটাই তিনি জানতেন না। আর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিল কলকাতার থিয়েটার রোডে। অনেকেই আবার বলে থাকেন সোনাগাছিতে। যুদ্ধের ময়দানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহিদ হয়েছে-এমন উদাহরণ একেবারেই বিরল। মূলত বাংলাদেশের তৎকালীন ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ যার যে অবস্থান ছিল সেই অবস্থান থেকেই যুদ্ধ করেছে। কিন্তু সেই জনযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ পুরো কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় স্বাধীনতা-উত্তর সরকার। যুদ্ধ করল জনগণ, রক্ত দিল সাধারণ মানুষ আর ক্ষমতা ভোগ করল আওয়ামী লীগ। যুদ্ধের ময়দানে যাদের কোথাও দেখা যায়নি, তারাই হয়ে পড়ল দেশের মালিক। ধরাকে সরা জ্ঞান করার মতো নেতাকর্মী-মন্ত্রী সবাই লুটপাটে নেমে পড়ে সদ্যস্বাধীন দেশটির বুকে। সেখান থেকেই সূচনা হয় আওয়ামী লীগের পতন। চূড়ান্ত পতন হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার মধ্য দিয়ে। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন চরম স্বৈরাচারী এক নেতৃত্বে। গোটা দেশকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে কায়েম করলেন বাকশাল। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা করা হয় রুদ্ধ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় তাদের। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবকিছুই করা হয় ভারতকে তুষ্ট রাখার চিন্তা মাথায় নিয়ে। বলা যায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেলেও আটকা পড়ে যাই ভারতের আধিপত্যবাদের নাগপাশে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ফিরে পায় যথার্থ স্বাধীনতা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম