Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

হানাফি মাজহাবের ক্রমবিকাশ

Icon

ওসমান গনি

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হানাফি মাজহাবের ক্রমবিকাশ

ফাইল ছবি

ইসলামি আইনচর্চার সূচনা হয় মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র জীবনকাল থেকেই। তিনি ছিলেন মানবজাতির জন্য পাঠানো সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রাসূল, যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা কুরআনের পূর্ণাঙ্গ বিধান ও নির্দেশাবলি মানুষকে প্রদান করেন।

নবীজির যুগে আইন নির্ধারণ হতো সরাসরি ওহির আলোকে এবং কোনো সমস্যা দেখা দিলে নবীজি (সা.) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তা সমাধান করতেন। কিন্তু তার ওফাতের পর ইসলামি সমাজে নতুন নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উদ্ভব ঘটে। এসব নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন পড়ে একটি সংগঠিত, সুসংহত ও বাস্তবমুখী আইনি কাঠামোর, যা যুগোপযোগী ও কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইসলামি ফিকহ বা আইনতত্ত্ব ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। হিজরির দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে এ ফিকহশাস্ত্র ব্যাপকতা অর্জন করে এবং একে ইসলামি ফিকহের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এ সময়ই বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফিকহি মতবাদ বা মাজহাব গড়ে ওঠে। এর মধ্যে হিজাজ ও ইরাকের কুফা নগরীকে ঘিরে যেটি গড়ে ওঠে, সেটিই পরবর্তী সময়ে হানাফি মাজহাব নামে খ্যাত হয়।

হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন অসাধারণ বিদ্বান, সুবিচারপ্রিয় এবং চিন্তাশীল ফকিহ ছিলেন। তার প্রকৃত নাম নু’মান ইবনে সাবিত। তিনি ইসলামি আইনকে শুধু একগুচ্ছ বিধিনিষেধের সমষ্টি হিসাবে নয়, বরং মানব জীবনের ন্যায়ভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর ও ভারসাম্যমূলক পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখতেন। তিনি ফিকহি আলোচনায় শুরা বা পরামর্শের পদ্ধতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং তার মজলিসে শিষ্যদের সঙ্গে মুক্তচিন্তার আলোকে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হতো।

ইমাম আবু হানিফার চিন্তার মূলভিত্তি ছিল কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ। তবে যখন সরাসরি দলিল পাওয়া যেত না, তখন তিনি কিয়াস (তুলনামূলক সিদ্ধান্ত), ইজমা (ঐকমত্য), ইস্তিহসান (নৈতিক বিবেচনায় উত্তম সমাধান) ও উরফ (প্রচলিত রীতিনীতি)-এর মতো মাধ্যম ব্যবহার করতেন।

চারটি প্রধান সুন্নি মাজহাবের মধ্যে হানাফি মাজহাব প্রথম গড়ে ওঠে এবং এটি আজও বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত ও অনুসৃত মাজহাব হিসাবে পরিচিত। ইমাম আবু হানিফার দুজন বিশিষ্ট শিষ্য, ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানি (রহ.)-এই মাজহাবের মূলনীতি সংকলন, ব্যাখ্যা ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

তারা ইমামের চিন্তাকে লিখিত আকারে রূপ দেন, যা পরবর্তী সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আইনতাত্ত্বিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এরপর ইমাম তাহাউই (রহ.), ইমাম আবিদিন (রহ.) প্রমুখ আলেমরা এ মাজহাবকে সমৃদ্ধ ও সুসংহত করেন।

হানাফি মাজহাবের মূল উৎসগুলো হলো আল-কুরআন, রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ, সাহাবিদের অভিমত (মাজহাবুস সাহাবি), ইজমা, কিয়াস, ইস্তিহসান এবং উরফ। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বাস্তব জীবনঘনিষ্ঠতার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রচলিত রীতিনীতিকে (যদি তা কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী না হয়) আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ইসলামি আইনের নমনীয়তা ও যুগোপযোগিতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে একজন অগ্রণী চিন্তাবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মনে করতেন, আইনের লক্ষ্য কেবল অপরাধ দমন বা শাস্তি প্রয়োগ নয়; বরং সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি আইনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ, সমাজে শৃঙ্খলা এবং দ্বীন ও দুনিয়ার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন। ফিকহি আলোচনা ও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তে তিনি অত্যন্ত পরিপক্বতার পরিচয় দেন এবং তার মজলিসে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জটিল সমস্যার সমাধান খোঁজা হতো। এ পদ্ধতি ছিল অনেকটাই আধুনিক গবেষণাভিত্তিক আলোচনা বা জুরিসপ্রুডেন্সের প্রাথমিক রূপ।

আব্বাসীয় ও পরবর্তী ওসমানীয় খেলাফতের আমলে হানাফি মাজহাব রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়। আদালতের অফিসিয়াল মাজহাব হিসাবে হানাফি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। খিলাফতের প্রধান বিচারপতি, কাজী ও ফিকহি উপদেষ্টা পদে হানাফি আলেমদের নিয়োগ দেওয়া হতো। এমনকি ওসমানীয় দরবারেও ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতো। তার ফতোয়া ও সিদ্ধান্তকে রাষ্ট্রীয় আইনের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হতো।

বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান প্রভৃতি দেশে হানাফি মাজহাবই প্রধান ধর্মীয় রীতি হিসাবে প্রচলিত। এসব দেশে ব্যক্তিগত আইন, বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকারসহ বহু বিষয়ে হানাফি ফিকহ অনুসরণ করা হয়। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বোর্ড থেকে শুরু করে মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রম পর্যন্ত এ মাজহাবের প্রভাব সুস্পষ্ট।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর চিন্তা, প্রজ্ঞা, যুক্তিবাদিতা ও পরামর্শভিত্তিক পদ্ধতি আজও ইসলামি আইনচর্চার ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত। তার মাজহাব শুধু একটি আইনি মতবাদ নয়, বরং এটি এক বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার ও চিন্তার ঐতিহ্য। হানাফি মাজহাব তার ঐকান্তিক সাধনা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও নেতৃত্বের এক গৌরবময় নিদর্শন, যা ইসলামি আইনের ইতিহাসে চিরকাল অম্লান থাকবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল ফিকহ অ্যান্ড লিগাল স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম