Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে মসজিদ

Icon

গোলাম রাসূল

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে মসজিদ

মসজিদ মুমিনের ঠিকানা। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মসজিদ সমাজ গঠনের মূলভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। যেখানে ইবাদত, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একত্রিত হয়। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণে যুগ যুগ থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে মসজিদভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। গবেষণায় দেখা যায় মসজিদভিত্তিক সমাজের দিকে মানুষ যত বেশি ঝুঁকেছে-সামাজিক শৃঙ্খলা, শান্তি, পারস্পরিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি ততই সুসংহত হয়েছে। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, আজকের বাংলাদেশেও মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ বিনির্মাণের দিকে আমরা যতটা এগিয়ে যাব সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা ততই মজবুত হবে।

মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে মুসল্লিদের কল্যাণকামী করে তোলে। প্রতিদিনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে মসজিদে যেতে হয়। নামাজের কাতারে ধনী-গরিব, আমির-ফকির, মালিক-শ্রমিকের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। ভেদাভেদ থাকে না পেশা, বংশ বা অর্থনৈতিক তারতম্যের। সবাই এক কাতারে অভিন্ন মর্যাদার মানুষে পরিণত হয়। মহান রবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি মুসল্লিরা পারস্পরিক কুশলবিনিময় ও খোঁজখবর নেওয়ার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলে একে অন্যের কল্যাণকামী, সহযোগী ও নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। এভাবে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট হওয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমানে পরিণত হয়। প্রকৃত মুসলমান হলো যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি)।

মসজিদ ইসলাম চর্চার মূল কেন্দ্র। রাসূল (সা.)-এর যুগে মসজিদে নববী ছিল দ্বীন শিক্ষার পাঠকক্ষ। একদল দরিদ্র সাহাবি, ইলমচর্চার জন্য মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন। তাদের আসহাবে সুফফা বলা হয়। তারা রাসূল (সা.)-এর মুখনিঃসৃত হাদিস সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুযোগ পেলেই মসজিদে এসে সাহাবিদের দ্বীন শেখাতেন। মসজিদভিত্তিক দ্বিনি জ্ঞানচর্চার ধারা অব্যাহত থাকলে মানুষ খুব সহজেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। আর যে সমাজে যত বেশি ইসলামি জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পাবে, সে সমাজ তত বেশি অপরাধ কমে যাবে। এ ছাড়া মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের সংস্কৃতি চালু থাকলে মুসল্লিরা নামাজের পাশাপাশি কুরআন-হাদিসসহ ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধ হতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নানাভাবে মসজিদভিত্তিক ইলমচর্চার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী (সা.) থেকে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে একমাত্র দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ অথবা শিক্ষাদানের জন্য আসবে, তার মর্যাদা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণকারীর মতো হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৭)।

মসজিদে নববী তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদে সব ধরনের ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যস্থার মাধ্যমে নবী (সা.) একটি জাতিকে সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে নামাজ-বন্দেগির পাশাপাশি (১) মসজিদভিত্তিক দ্বীনি শিক্ষা, (২) উচ্চতর ইসলামি গবেষণা, (৩) চিকিৎসাসেবা, (৪) সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, (৫) ইসলামি লাইব্রেরি, (৬) শিশু-কিশোরদের জন্য ইসলামি সংস্কৃতি ও (৭) নানা ধরনের মানবিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মসজিদের শিষ্টাচার রক্ষা করতে হবে এবং ইসলামি আদর্শ ও নীতিমালার আলোকে মসজিদ পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের। দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক জীবনের মুক্তির লক্ষে মসজিদকেন্দ্রিক ইসলামের আর্থিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। অধিকাংশ জনগণকে দরিদ্র রেখে ও আয়-বৈষম্য বজায় রেখে কোনো দেশই বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারে না। আল্লাহ জাকাতের গুরুত্ব দিয়েছেন এভাবে : ‘আমি যদি তাদেরকে (মুমিনগণ) পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, আর সব কাজের চূড়ান্ত পরিণতি একান্তই আল্লাহর ইচ্ছাধীন।’ (সূরা হাজ : ৪১)।

তাই সাধারণ জনগণের মাঝে এ ধারণার ব্যাপক বিস্তরণ ঘটাতে হবে যে, ইসলামের আর্থিক দারিদ্র্য বিমোচনের সুনিশ্চিত সামাধান রয়েছে। সেজন্য মসজিদকেন্দ্রিক নিয়মিত সদকা সংগ্রহ ও বণ্টন করতে হবে দরিদ্র জনগণ, মিসকিন ও মুসাফিরের মাঝে। এজন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষ দান-সদকা গ্রহণকারীদের তথ্য বা ডাটা সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। পুরো সপ্তাহে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে কত টাকাই তো দান করি। কিন্তু প্রত্যেকের টাকা একত্রিত করলে সপ্তাহে না হোক মাসে অন্তত একজন অভাবীকে স্থায়ীভাবে সামর্থ্যবান করে তোলা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত মসজিদকেন্দ্রিক ইসলামের আর্থিক ব্যবস্থাকে মজবুত করতে বার্ষিক জাকাত সংগ্রহ করা যেতে পারে মসজিদের এলাকা-গ্রামের মানুষের থেকে। প্রয়োজনে অন্য অঞ্চলের মানুষের থেকেও সংগ্রহ করা যেতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে যারা জাকাত দেয় তাদের বিষয়টি বোঝাতে হবে-তাদের থেকে যে অংশটি সংগ্রহ করা হবে তা দিয়ে সামষ্টিক কাজে লাগানো হবে। জাকাতের অর্থে বেকার-অসহায় লোকজনকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে সেটা টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ হয়। আজকের বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের অবস্থা হুমকির সম্মুখীন। দেশের দরিদ্র জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অর্থের অভাবে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে না ও ওষুধ কিনতে পারে না। চাহিদার তুলনায় সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপ্রতুল। দেশের ও দেশের বাইরের সামর্থ্যবান ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে মসজিদের মাধ্যমে জনগণের জন্য এ সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। সমাজে দু-চারজন মহৎ চিকিৎসক নিশ্চয় আছেন যারা মাসে একটি দিন বিনামূল্যে রোগী দেখে চিকিৎসাপত্র বা প্রেসক্রিপশন দেবেন। চারজন চিকিৎসক যদি পাওয়া যায় তাহলে প্রতি মাসে চার সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিন এ সেবার ব্যবস্থা করা যেতে পরে। সেইসঙ্গে দাতব্য প্রতিষ্ঠান/আগ্রহী ওষুধ কোম্পানি/ব্যক্তি থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে বণ্টন করতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক অনুশীলন ও জীবনযাপন পদ্ধতির প্রতি বিশেষ পরামর্শ প্রদান করুন। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক-আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে গেলে সেখানে আমাকে পেতে...’ (মুসলিম-২১৬২)। তাই মানবসেবার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।

মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য প্রথমে এলাকার সৎ, দায়িত্ববান ও যোগ্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। মসজিদের এলাকা নির্ধারণ করে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি করে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন হবে। সব ধরনের দলীয় রাজনীতিকে বর্জন করে শুধু দ্বীনি কাজ হিসাবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হয়ে কাজগুলো করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় অর্থ, মতৈক্য ও সুষ্ঠুভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন।

লেখক : ধর্মীয় গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম