কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট
লোকগান চর্চার আঁতুড়ঘর ‘মায়ের তরী’
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে গড়ে উঠেছে লোকগান ও লোক সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র ‘মায়ের তরী’। সেই সংগঠনের উদ্যোগে এই দুই জেলায় ৬ শতাধিক শিশু শিখছে লালনগীতি, মারফতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতিসহ বিভিন্ন লোকগান।
শিখছে বাঁশি, একতারা, দোতরা, খমোক, সারিন্দা, তবলা, বাংলা ঢোল, বেহালাসহ বিভিন্ন লোক বাদ্যযন্ত্র। আধুনিক, মেলোডি ও ব্যান্ডের গানের রঙিন হাতছানির মধ্যেও ‘মায়ের তরী’র এমন উদ্যোগ ব্যাপক সারা জাগিয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। শনিবার সরেজমিন কুড়িগ্রাম শহর থেকে ১৫ কিলোমিটর দূরে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের সিংহীমারী গ্রামের মেঠোপথ ধরে যেতেই কানে বাজে শিশুদের সমবেত কণ্ঠে লোকগান।
গানের সুর ধরে এগোতেই চোখে পড়ে ‘সেবালয় গুরুগৃহ’-এর ছোট্ট সাইনবোর্ড। জীর্ণ টিনশেড ঘরের মেঝেতে সত্তর-আশিটি শিশু একসঙ্গে গলা ছেড়ে গাইছে। সংগঠনটির পরিচালক সুজন কুমার বেদ জানান, নরওয়ের নাগরিক কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথের বাংলা ও বাঙালি লোকসংস্কৃতিচর্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের মতো সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠন ‘মায়ের তরী’। এখানে ৬ শতাধিক শিশু লোকসংগীত ও লোক বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখছে। সেই সঙ্গে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, ‘মায়ের তরী’ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি দর্শন, একটি আন্দোলন।
সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত লেখক ও গবেষক ইউসুফ আলমগীর বলেন, মায়ের তরীর প্রধান কার্যালয় লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর দেওডোবা গ্রামে। এই সংগঠনের মাধ্যমে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে চালু হয়েছে ৯টি ‘গুরুগৃহ, যেখানে ৪৬০ জন শিশু শিখছে বাংলা লোকগান এবং দুটি লোক বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ১২৫ জন শিক্ষার্থী শিখছে লোক বাদ্যযন্ত্র।
সেই সঙ্গে একটি তরীর ক্লাস পরিচালিত হয়, যেখানে ১৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিমাসে দিনব্যাপী বিশেষ ক্লাসে লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারা সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করে। এখানে প্রতিটি গুরুগৃহের গুরুরা নিজ নিজ গৃহে শিক্ষাদান করেন। বিনা অর্থে শিশুরা তবলার ছন্দে, দোতারা বা একতারা বাজিয়ে শিখছে লালন, বাউল, মুর্শিদি, মারফতি, ভাওয়াইয়া আর পল্লিগানের সুর।
শিখছে বেহালা, একতারা, দোতারা, বাঁশি, তবলা, খমোক, সারিন্দাসহ লুপ্তপ্রায় লোক বাদ্যযন্ত্র বাজানো। মায়ের তরীর অন্যতম সংগঠক ইউসুফ আলমগীর জানান, ‘লোকসংগীতচর্চার মাধ্যমে শিশুদের আত্মশুদ্ধি ও জীবন বৃদ্ধি’-এই চিন্তাকে ধারণ করে তাদের সংগঠন গ্রামবাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া সুর ও শব্দকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ করছে। এখন এই অঞ্চলে মায়ের তরীর গুরুগৃহগুলো হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধারার লোকগানচর্চার আঁতুড়ঘর।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা নরওয়ের নাগরিক উয়েরা সেথের বলেন, পৃথিবীতে যে যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রকৃতির বিপর্যয়, তাতে এই সমাজকে সুস্থ রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানে আমার মনে হয়েছে লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদিসহ লোকসংগীত সেই অস্থিরতা থেকে মানুষকে স্থির করতে পারে। মানুষকে মানবিক আর প্রকৃতিপ্রেমী করতে পারে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে আমি যাত্রা করেছি। আর সমাজের ছোট্ট একটি অংশ ‘মায়ের তরী’। খুব চেষ্টা করছি শিশুদের লোকসংগীত শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক হিসাবে গড়ে তোলার। উল্লেখ্য, উয়েরা সেথের প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৮ সালে।
সেসময় তিনি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চর এলাকায় বন্যাপরবর্তী মানুষের জীবন দেখতে যান। সেখানে চরের নারীদের কণ্ঠে মারফতি ও মুর্শিদি গান শুনে সেই সুরের প্রেমে পড়েন। পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মারফতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, লালননহ নানা লোকগানে তিনি সমৃদ্ধ হন। স্থানীয় লোকশিল্পী ও সংগঠকদের নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের তরী। সেই সঙ্গে ৫৩টি লালনগান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে একটি বইও প্রকাশ করেন।
