Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ব্যবসায়ীকে সিরিয়াল কিলার রায়হানের হুমকি

‘তোকে গুলি করে না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’

চট্টগ্রামে দীর্ঘ হচ্ছে খুনের তালিকা, মাস্টারমাইন্ড ও সন্ত্রাসীরা অধরা

Icon

এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘তোকে গুলি করে না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’

মোহাম্মদ রায়হান। ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

চট্টগ্রামে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। কথা কাটাকাটির জেরে কিংবা ছোটখাটো বিষয়ে খুন করতে দ্বিধা করছে না খুনিরা। প্রকাশ্যে গুলি করে বা ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নগরী ছাড়াও গত এক বছরে চট্টগ্রামের চার উপজেলায় কমপক্ষে ৪০টি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৩০টি খুনই হয়েছে গুলিতে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাস্টারমাইন্ড ও হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে খুনিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে প্রকাশ্যে গুলি করে চট্টগ্রামে একের পর এক খুনের ঘটনায় উঠে আসছে কারান্তরীণ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের সহযোগী মোহাম্মদ রায়হানের নাম। একাধিক খুনের মামলার আসামি এই সিরিয়াল কিলারকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজলেও থেমে নেই তার অপরাধ। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দিয়েছে। ওই ব্যবসায়ীকে রায়হান বলেছে, ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব।’ হুমকি পাওয়া ওই ব্যবসায়ীর নাম মো. একরাম। সম্প্রতি চট্টগ্রামে নির্বাচনি গণসংযোগে গুলিতে খুন হওয়া সরোয়ার বাবলাকেও রায়হান ফোনে বলেছিলেন, ‘তোর সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ প্রশাসন এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে। এ কারণে চট্টগ্রাম এখন খুনের জেলায় পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রামে একদিনে ৩ খুন : সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় একদিনে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। মোবাইল সার্ভিসিংয়ের পাওনা ১২০০ টাকা চাওয়ায় নগরীর কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতে আকাশ ঘোষ (২৬) নামে এক যুবককে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। একইদিন রাত দশটার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড মধ্যম সরফভাটা এলাকায় খুন হন আবদুল মান্নান (৪০)। তিনি ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। তার শরীরে চারটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এরমধ্যে একটি বাম চোখের কাছে, বাম হাতে একটি এবং পেটের ডানপাশে দুটি গুলির চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ। অপরদিকে ফটিকছড়ি উপজেলায় ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আবদুল্লাহ আল মাসুদ (৩২) নামে এক যুবককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

‘তোকে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে মারব’ : গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিংমলে ঘুরতে দেখে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন মো. একরাম নামে এক ব্যবসায়ী। শুক্রবার রাতে ওই ব্যবসায়ীকে মুঠোফোনে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সন্ত্রাসী রায়হানের বিরুদ্ধে। ওই ব্যবসায়ীকে রায়হান বলেন, ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব।’ ছোট সাজ্জাদ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তার বাহিনী ও অস্ত্রের দেখভাল করছেন রায়হান। এর আগে সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না এবং বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ একরামকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। ওই হুমকির ঘটনায় তিনি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছিলেন। এরপর মামলা তুলে নিতেও তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। নতুন করে হুমকির বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী একরাম। তবে বড় সাজ্জাদ এবং সিরিয়াল কিলার রায়হান এখনো অধরা।

২৫ অক্টোবর মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতলে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল কর্মী আলমগীর আলমকে। এই হত্যা মামলায় রায়হানকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ডে রায়হান ভাড়াটে হিসাবে কাজ করেছে। জীবিত অবস্থায় মুঠোফোনে আলমগীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে আলমগীরকেও রায়হানের নাম উল্লেখ করে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এরপর ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনি জনসংযোগে অংশ নেওয়া সিএমপির তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলাকে (৪৩) গুলি করে হত্যা করা হয়। এর তিন দিন আগে বাবলাকে ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন রায়হান। নিহত সরোয়ার বাবলার বাবা জানান, রায়হান সরোয়ারকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘তোর সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে।’ এছাড়া রাউজান ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ইতোমধ্যে সংঘটিত আরও একাধিক খুনের ঘটনা রায়হান নিজেই ঘটিয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, অপরাধ দমনে পুলিশ কাজ করছে। এর মধ্যেও খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। যখন আমরা বড় কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করি বা অস্ত্র উদ্ধার করি তখন এটাকে সফলতা বলা হয়। আবার একটি খুনের ঘটনা ঘটলেই যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এটা বলার সুযোগ নেই। এখানে সফলতা, ব্যর্থতার বিষয়টি আপেক্ষিক। অপরাধী দমনে সিএমপি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে।

তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও কিছু সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে খুনখারাবি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়াই এর একমাত্র কারণ। পুলিশ এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে। তারা এখনো গণ-অভ্যুত্থানের জায়গা থেকে শিক্ষা নেয়নি। এছাড়া সেনাবাহিনীর সর্বোত্তম সংযমের কারণেও সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দীর্ঘদিন মাঠে থাকায় সেনাবাহিনীকে অপরাধীরা ভয় না পাওয়ার একটি প্রবণতা শুরু হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সময়ের চিহ্নিত সন্ত্রাসী যারা ছিল তারাতো এখন নেই। তাদের মধ্যে কেউ পালিয়েছে, কেউ কারাগারে আছে। সেক্ষেত্রে সমাজ তো শান্ত থাকার কথা। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের চিহ্নিত ও দাগি আসামিরা জেল থেকে বের হয়ে গেছে। তাদের বের করল কারা? আধিপত্য বিস্তারের কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় তারা রয়েছে। এর দায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। কারণ নির্বাচনে অনেক সন্ত্রাসী বিভিন্ন প্রার্থীর হয়ে কাজ করবে।’ সেক্ষেত্রে অপকর্ম অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম