Logo
Logo
×

শেষ পাতা

উপকূলের জীবন

সংকটে-সংগ্রামে চলমান হাতিয়ার মানুষের জীবন

Icon

মুহসিন আল জাবির, হাতিয়া (নোয়াখালী)

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকটে-সংগ্রামে চলমান হাতিয়ার মানুষের জীবন

দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে মেঘনার বিশাল মোহনায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক দ্বীপ-‘হাতিয়া’। নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ২১০০ বর্গকিলোমিটার। মেঘনার বুকে ভাসমান এই দ্বীপের মনকাড়া সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা স্বপ্ন জাগালেও উন্নয়নের ছোঁয়া এখানকার ৬ লাখ মানুষের কাছে এখনো সুদূরপরাহত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। সংকট রয়েছে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থার। নদী ও সাগরে মাছ ধরা এবং কৃষি প্রধান পেশা। দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র নিঝুম দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সেবা দিয়েও কিছু মানুষের জীবিকা চলে। মাছ ধরতে গিয়ে পড়তে হয় জলদস্যুর কবলে। প্রতিনিয়ত নদীভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি, বসতভিটা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে সঙ্গী করে নিরন্তর সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় এখানকার মানুষকে। এর মাঝেই সুখ খোঁজে নেন তারা। একজনের বিপদে আরেকজন পাশে এসে দাঁড়ান।

উত্তরে সুবর্ণচর ও রামগতি, দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে মনপুরা-এভাবেই গড়ে উঠেছে হাতিয়ার ভূচিত্র। মেঘনার স্রোত আর সমুদ্রের ঢেউ যুগ যুগ দ্বীপটিকে ভেঙেছে, আবার গড়েও তুলেছে নতুন চর। প্রাচীন সভ্যতা, কিংবদন্তি সাধক, সমুদ্রযাত্রী বণিক এবং ঔপনিবেশিক ভ্রমণকারীর স্মৃতিচিহ্নে ভরা হাতিয়ার ইতিহাস। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দীতেই মানুষ এখানে বসবাস শুরু করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘বারো আউলিয়া’ নামে খ্যাত বারোজন আউলিয়ার আগমন ঘটে, যারা ইসলামের বাণী প্রচার করেন। বিখ্যাত সাধক বায়েজিদ বোস্তামী, হজরত শাহ আলী বোগদাদি ও সুলতান ইব্রাহীম বলখি মাহীসাওয়ারও এখানে অবস্থান করেছিলেন। নবম শতকে গড়ে ওঠে হাতিয়ার প্রথম জামে মসজিদ, যা ১৭০২ সালে নদীগর্ভে বিলীন হয়। এখানে রয়েছে ৪১০টি মসজিদ, ১৪টি মন্দির এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি, ক্লাব, সিনেমা হল। শিক্ষার হার প্রায় ৩৪.২ শতাংশ।

জীবন-জীবিকা : হাতিয়ার জীবনধারা নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতী’। দ্বীপের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি (৬৫%)। ধান, পাট, আলু, আখ, ডাল, তৈলবীজ, পান এখানকার মূল ফসল। নারিকেল, সুপারি, মধু ও শুঁটকি রপ্তানি হয়। মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগি পালন এবং কুটিরশিল্প অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলাটি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। নানা অভাব-অপ্রাপ্তি, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষার সংকট মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। হাতিয়াবাসী অনেকেই বিদেশমুখী। ভোরে জেলেদের নৌকা নদীতে ভেসে যায় মাছ ধরার আশায়, আবার কৃষক জমিতে নেমে পড়েন ধান কিংবা সবজি চাষে। বৃষ্টির পানি, নদীর স্রোত আর সাগরের ঢেউ-এসবই তাদের জীবনের চালিকাশক্তি। ইলিশসহ অসংখ্য সামুদ্রিক মাছের জন্য বিখ্যাত হাতিয়া। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর হাজার টন মাছ দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ হয়। সঠিক সংরক্ষণ ও আধুনিক মৎস্য গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুললে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বাড়বে। হাতিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অনেক সময় সাগরে জলদস্যুদের হামলায় হারাতে হয় সর্বস্ব, দিতে হয় প্রাণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে জলদস্যুদের তৎপরতা কমলেও কিছুদিন পরই তা আবার বেড়ে যায়।

যোগাযোগব্যবস্থা : সন্ধ্যার পর দ্বীপবাসী মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাতে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। জরুরি চিকিৎসা নিতে নোয়াখালী পৌঁছানো কঠিন ও অসম্ভব হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ ও নদীপথে যোগাযোগব্যবস্থা হাতিয়ার মানুষের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ। চেয়ারম্যানঘাট থেকে নলচিরা পর্যন্ত সি-ট্রাক চললেও তা নির্ভর করে ইজারাদারের মর্জির ওপর। জোয়ার-ভাটা কিংবা নদীর উত্তাল স্রোত-সবই যাত্রীদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভরসার প্রধান মাধ্যম ট্রলারগুলোও অধিকাংশই ফিটনেসবিহীন। সমুদ্রগামী মাছ ধরার বড় ট্রলারগুলো যাত্রীবাহী হিসাবে ব্যবহার হয়। যেখানে নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি যাত্রীর সলিলসমাধি হয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে নৌ যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ পথ হাতিয়া চ্যানেল। স্বর্ণদ্বীপ, ভাসানচর ও নিঝুমদ্বীপের অবস্থান এই রুটকে দিনদিন কৌশলগতভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। আধুনিক নৌবন্দর, সমুদ্র গবেষণাকেন্দ্র ও শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য হাতিয়া হতে পারে দেশের নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু।

ভাঙনে সংকটের মুখে অস্তিত্ব : হাতিয়ার অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে। অব্যাহত নদীভাঙনে প্রতিবছরই দ্বীপটি ছোট হয়ে আসছে। এলজিইডির তথ্যমতে, ২১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে প্রায় ৬ লাখ মানুষ বসবাস করে। কিন্তু প্রতিবছর পাঁচ শতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নতুন জেগে ওঠা চরে আশ্রয় নেয়। সেখানে নেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা নিরাপদ বসতি। গত অর্ধশতকে হাতিয়ার অন্তত তিনটি ইউনিয়ন-হরণী, চানন্দী ও লক্ষ্মী সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে মেঘনার গর্ভে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮০ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। গত দুই বছরে সুখচর ও নলচিরাও বিলীন হওয়ার পথে। প্রতিবছর নদীভাঙনে হাতিয়ার মানুষের প্রায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। হারিয়ে যায় কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ-মন্দির ও বাজার। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকা চরম সংকটে পড়ে। কৃষিজমি কমে যাওয়ায় উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, আর বাড়ছে দারিদ্র্য।

বেহাল স্বাস্থ্যসেবা : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করলেও চিকিৎসাসেবায় জনবল বাড়ানো হয়নি। ছয় লাখ মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব মাত্র সাতজন চিকিৎসকের ওপর। ফলে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খান তারা। ৭৯টি কর্মী পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৫৩টি। ডাক্তার-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পদে কর্মীর অভাব প্রকট। ৩১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে উপস্থিত আছেন ১০ জন, যার মধ্যে নিয়মিত কর্মরত সাতজন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসক ও কর্মীর অভাবে সেগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না।

দ্বীপের মানুষের সরল জীবন : দ্বীপের মানুষের জীবন সহজসরল, নিরহংকার ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম। গাছের ছায়া, সাগরের বাতাস, নদীর কোল ঘেঁষে বসতি-সবকিছুই তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানকার মানুষ একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি। বিপদে-আপদে প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন নিজের মানুষ ভেবে। দ্বীপবাসীর জীবন শুধু প্রকৃতির সঙ্গে নয়, সংস্কৃতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। লোকনৃত্য, গ্রামীণ গান, পালাগান কিংবা গল্প বলার আসর-এসবই তাদের বিনোদনের উৎস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারক।

পর্যটন : পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় হাতিয়া। সাগরের নীল জলরাশি, বালুকাময় সৈকত আর অপরূপ সূর্যাস্ত পর্যটকদের টেনে আনে। হাতিয়ার দক্ষিণপ্রান্তের নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় সমুদ্রের প্রেমগাথা। ২০০১ সালে প্রায় ৪০ হাজার একর এলাকা জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়, যেখানে বন, হরিণ, পাখি, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের এক অপার ভান্ডার রয়েছে। নোয়াখালী এই উপকূলীয় উপজেলা প্রকৃতির এক বিস্ময়ভূমি। যেখানে নদী, সাগর, চর আর সবুজের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। দেশের মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণদ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ ও ভাসানচর-এই তিনটি দ্বীপই হাতিয়ার গর্ব, যা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত। চারপাশে নদী ও সাগরের বুকে ভেসে থাকা ১৫টিরও বেশি চর আর অর্ধশতাধিক ডুবোচর হাতিয়াকে করেছে অনন্য। উত্তরে মেঘনা নদী, পশ্চিমে হাতিয়া নদী, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর-এ যেন প্রকৃতির আঁকা এক জীবন্ত ক্যানভাস। যদি পর্যটন অবকাঠামো উন্নত করা যায়, তাহলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ঢল নামবে এখানে।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি হাতিয়ার জীবন চিরকাল সংগ্রামমুখর। ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে অগণিত প্রাণহানি, ঘরবাড়ি ও ফসলের ধ্বংস দ্বীপবাসীর মনে আজও তাজা ক্ষত। তবুও তারা টিকে আছেন সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে, নতুন চর জয় করে, নতুন ফসল ফলিয়ে।

তবুও হাতিয়ার মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখেন-কোনো একদিন উন্নয়নের আলো এসে ছুঁয়ে যাবে তাদের দ্বীপকে, থামিয়ে দেবে নদীর গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার এই অবিরাম যাত্রা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম