আন্ডারওয়ার্ল্ডের দ্বন্দ্বে খুন হন মামুন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর অপরাধজগতে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে খুন হন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুন। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম এ তথ্য দেন। তিনি বলেন, মামুনকে হত্যার নির্দেশ দেন তার একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী রনি। হত্যাকারীদের দুই লাখ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি (রনি)।
ডিবিপ্রধান জানান, মামুন হত্যায় মোট ৯ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। হত্যায় সরাসরি অংশ নেন মো. ফারুক হোসেন ফয়সাল ও রবিন আহম্মেদ পিয়াস। তাদের সহায়তা করেন শামীম আহম্মেদ, মো. ইউসুফ ওরফে জীবন ও মো. রুবেল। এদিকে আদালত সূত্র জানায়, অস্ত্র আইনের মামলায় বুধবার পাঁচজনকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো. সাজ্জাদ হোসেন। মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তিনি ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। শুনানি শেষে বিচারক পার্থ ভদ্র চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ডিবির ভাষ্যমতে, পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে দীর্ঘদিন ধরেই ইমন-মামুন গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব চলছিল। একই গ্রুপে থাকা ইমন ও মামুনের সম্পর্ক একসময় ভেঙে যায়। মামুন জেল থেকে জামিনে বের হয়ে এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলে ইমনের ঘনিষ্ঠ রনি তাকে (মামুন) হত্যার পরিকল্পনা করেন। রনি তার সহযোগী ফারুক ও রবিনকে ডেকে মামুনকে হত্যার প্রস্তাব দেন এবং দুই লাখ টাকা ‘পুরস্কার’ ঘোষণা করেন। ফারুকের সহায়তায় রনি পুরো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।
ডিবি জানায়, ১০ নভেম্বর মামুনের একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। আগের দিন রাতে মিরপুরের কাফরুলে রনির বাসায় বসে এই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়। মিশন সম্পন্ন হলে ফারুক ও রবিনকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পরদিন সকালে রনি ফোনে নির্দেশ দেন-সবাই আদালত এলাকায় অবস্থান নেবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, শামীমের মোটরসাইকেলে রবিন আদালতের সামনে পৌঁছান, ফারুক আসেন অন্যদিক থেকে। রনির সহযোগী কামাল মামুনের গতিবিধি নজরে রাখেন এবং সংকেত পাঠান। সংকেত পেয়ে ফারুক ও রবিন মামুনকে লক্ষ্য করে একযোগে গুলি চালিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। গুরুতর আহত মামুনকে প্রথমে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর ফারুক ও রবিন বেড়িবাঁধ হয়ে মোহাম্মদপুর রায়েরবাজারে যান। রুবেলের মাধ্যমে সেখানে তাদের হাতে দুই লাখ টাকা পৌঁছে যায়। রনির নির্দেশে তারা হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র রুবেলের কাছে জমা রাখেন। পরে রুবেল অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন দরজি ব্যবসায়ী ইউসুফের বাসায়। এরপর সবাই সীমান্তপথে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেন। তারা সিলেট সীমান্তে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর সাতক্ষীরায় যাওয়ার উদ্দেশে সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর ভেলানগর থেকে ডিবির হাতে ধরা পড়েন তারা। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রায়েরবাজারে অভিযান চালিয়ে ইউসুফকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি বিদেশি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন।
ডিবিপ্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, হত্যার পরই ডিবির একাধিক দল ছায়া তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামিদের গতিবিধি চিহ্নিত করা হয়। ফুটেজ ও তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এই পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, এটি ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আধিপত্যের লড়াই থেকেই এই হত্যার সূত্রপাত। রনির নির্দেশে ফারুক, রবিন, রুবেল, শামীম, ইউসুফসহ অন্যরা বিভিন্নভাবে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন।
শফিকুল ইসলাম বলেন, এই হত্যার মাস্টারমাইন্ড রনি এখনো পলাতক। সে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীদের মোবাইল ফোন নিজের কাছে নিয়ে নেয়, যাতে অবস্থান শনাক্ত করা না যায়। হত্যার পর সবার গতিবিধি লুকাতে সে নিজেও সিলেটগামী হয়। তাকে ধরতে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চলছে। এই ডিবি কর্মকর্তা আরও জানান, সানজিদুল ইসলাম ইমন সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্রমতে, মামুন হত্যার পর রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পুরান ঢাকা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ইমন-মামুন গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মাদক, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে ছিল। মামুনের মৃত্যুর পর পুরো সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব নিয়ে এখন নতুন করে হিসাবনিকাশ চলছে। তিনি আরও বলেন, রনিকে গ্রেফতার করা গেলে হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ ও পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
