দুই দশকে রাঙানো সোনারগাঁয়ের বর্ণিল উৎসব
দেওয়ান সামছুর রহমান
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রং-তুলি হাতে স্বপ্ন আঁকছে শিশুরা। কেউ ফুটিয়ে তুলছে বাংলার প্রকৃতি, কেউ সোনারগাঁয়ের ইতিহাসের সোনালি স্মৃতি। হাসিমুখে শিশুদের কোলাহলে মুখর সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের লাইব্রেরি। ৭ নভেম্বর শুক্রবার সকাল থেকেই এমন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ দিনটি শুধু একটি প্রতিযোগিতার নয়, বরং দুই দশকের পথচলার আনন্দ উদযাপন।
স্বজন সমাবেশ সোনারগাঁ শাখা পূর্ণ করতে যাচ্ছে তাদের দ্বিতীয় দশক। ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯টি বসন্ত পেরিয়ে ২০ বছরে পা রাখল এ সংগঠন। এ উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী চলে আলোচনা সভা, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ ও ডেঙ্গু মশা নিধন কর্মসূচি। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশন।
শুক্রবার সকাল ১০টার মধ্যেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসে সোনারগাঁ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ জন খুদে শিল্পী। ১১টা বাজতেই জাদুঘরের লাইব্রেরি কক্ষ যেন রং ও আনন্দের মেলায় পরিণত হয়। কেউ তুলিতে ফুটিয়ে তুলছে নদী, কেউ আঁকছে প্রাচীন স্থাপনা, বড় সর্দার বাড়ি, কেউবা কল্পনায় গড়ে তুলছে রঙিন গ্রামবাংলা।
সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী হলেও ‘খেলাঘর’ সোনারগাঁ শাখার নামে প্রায় ৪০ জন শিশু-কিশোর এতে অংশ নেয়। এক ঘণ্টার রঙের খেলা শেষে দুপুর ১২টায় শেষ হয় প্রতিযোগিতা। চিত্রাঙ্কনের এ কার্যক্রমে স্বজনদের পাশাপাশি ছিল বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। বিশেষ করে সর্বোপরি আয়োজন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সোনারগাঁ খেলাঘরের শিক্ষকরা। শিশুদের মুখে হাসি, হাতে তুলি-চারপাশে যেন রঙের উৎসব। বেশির ভাগ শিশু সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিজেদের ভাবনা ফুটিয়ে তোলে তাদের ক্যানভাসে।
মশিউর, সফিকুল, ঐশীদের সহযোগিতায় মিলন স্যার, কাজল স্যার ও তার দল ৩০ মিনিটের মধ্যেই বিচার কার্য সম্পন্ন করে ফেলেন। ফল ঘোষণা করা হয় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হয় লোকজ জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার হলরুমে। প্রতিযোগিতায় শিশুদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ গ্রুপ। ‘ক’ গ্রুপে ১ম স্থান অর্জন করে মৃত্তিকা রায় (২য় শ্রেণি), ২য় স্থান যারিন তাসনিম মাহিরা (২য় শ্রেণি) ও ৩য় স্থান অর্জন করে স্পর্শ (২য় শ্রেণি)। ‘খ’ গ্রুপে ১ম স্থান অর্জন করে দেওয়ান ওমর গালিব রাফিন (৩য় শ্রেণি), ২য় স্থান মালিহা আক্তার (৩য় শ্রেণি) ও ৩য় স্থান অর্জন করে মানহা কবির (৫ম শ্রেণি)। ‘গ’ গ্রুপে ১ম স্থান অর্জন করে আরাধিতা সিংহ সৌমি, ২য় স্থান অর্জন করে আকশাদা হোসেন ও ৩য় স্থান অর্জন করে ফারিহা তাবাসসুম।
চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন সোনারগাঁ উপজেলা খেলাঘরের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক, অপূর্ব সাংস্কৃতিক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও নৃত্যশিল্পী মিলন হোসাইন; খেলাঘর সোনারগাঁ উপজেলা শাখার সম্পাদক ও শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক কাজল বণিক এবং শিল্পকলার অঙ্কনবিষয়ক প্রশিক্ষক গোবিন্দ দাস।
ফল ঘোষণা করেন বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন। বিজয়ী ৯ জনকে রেখে বাকিদের হাতে সান্ত্বনা পুরস্কার তুলে দেন যুগান্তর স্বজন সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক ইমন চৌধুরী, যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার ও স্বজন উপদেষ্টা আল-আমিন তুষার ও স্বজন সভাপতি দেওয়ান সামছুর রহমান।
পুরস্কার হিসাবে বিজয়ীদের জন্য ছিল ক্রেস্ট, সনদপত্র, ফাইল, রং পেনসিল ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সোনারগাঁও’ এবং স্বজন সভাপতি দেওয়ান সামছুর রহমানের লেখা ‘সোনারগাঁয়ের সোনালি ইতিহাস’ গ্রন্থ। আর সান্ত্বনা পুরস্কার ছিল রং পেনসিল ও ফাইল।
এরপর জুমার নামাজ ও দুপুরের খাবারের বিরতি। বিরতি শেষে দুপুর ২.৩০টায় জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার হলরুমে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী পর্ব ও আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক (উপসচিব) কাজী মাহবুবুল আলম। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন একেএম আজাদ সরকার (উপপরিচালক, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন), দেলোয়ার হোসেন (ওসি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নারায়ণগঞ্জ), ইমন চৌধুরী (বিভাগীয় সম্পাদক, যুগান্তর স্বজন সমাবেশ), কাওছার মাহমুদ (সিনিয়র আর্টিস্ট) দৈনিক যুগান্তর, অ্যাডভোকেট নাদিরা আক্তার নীরা (প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশন), আল আমিন তুষার (স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর, সোনারগাঁ) ও ইঞ্জিনিয়ার মো. মোক্তার হোসেন (ভাইস চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন)। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনের সভাপতি মশিউর রহমান।
সভাপতিত্ব করেন সোনারগাঁ শাখার সভাপতি দেওয়ান সামছুর রহমান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্বজন সমাবেশের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ইমরান হোসেন, আরশাদ হোসেন অন্য, কামরুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, নৃত্যশিল্পী মিলন হোসেন, কাজল বনিক, স্বজন ফারহানা আক্তার, জিতু, দেওয়ান জান্নাতুল ফেরদৌসী ঐশী, মাহী, শশী প্রমুখ।
বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধান অতিথি কাজী মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘শিশুরা যখন তুলির আঁচড়ে দেশ, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে তখন তাদের মধ্যে মানবিকতা ও দেশপ্রেম গড়ে ওঠে। স্বজনদের এ আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।’ বিশেষ অতিথি ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘যুগান্তর স্বজন সমাবেশ ও বিসমিল্লাহ এনএম ফাউন্ডেশনের এ কার্যক্রম সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ।’ বিশেষ অতিথি যুগান্তর স্বজন সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক ইমন চৌধুরী বলেন, ‘সারা দেশে স্বজনরা সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসাবে বছরব্যাপী কাজ করে থাকেন।’ যুগান্তর স্টাফ রিপোর্টার ও স্বজন উপদেষ্টা আল-আমিন তুষার বলেন, ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক দৈনিক যুগান্তরের সোনারগাঁয়ের স্বজনরা দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বৃক্ষ রোপণ, অসহায় দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’
বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন বলেন, ‘বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনও একটি সামাজিক সংগঠন। আমরা যুগান্তর স্বজনদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আনন্দিত। আশা করি সামনের দিনগুলোতেও যুগপৎ পথ চলব।’
এরপর প্রধান অতিথি জাদুঘরের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলমের হাত থেকে শিশুরা পুরস্কার গ্রহণ করে। সভাপতি দেওয়ান সামছুর রহমান সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সঞ্চালক ও স্বজন সমাবেশের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামানের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় সবাইকে মুগ্ধ করে।
অনুষ্ঠান শেষে বিকালে শুরু হয় ডেঙ্গু মশা নিধন কর্মসূচি। দেশব্যাপী ডেঙ্গুর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে এ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। বিসমিল্লাহ এনএম জুলফিকার ফাউন্ডেশনের নিজস্ব মেশিনে সম্পূর্ণ জাদুঘর চত্বর ও তার আশপাশে এ মশক নিধন কর্মসূচি চলে। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে মশার ওষুধ স্প্রে করে স্বজন সদস্যরা উদাহরণ স্থাপন করেন সমাজসেবায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। দিনব্যাপী এ আয়োজন সোনারগাঁয়ের স্বজনদের উপস্থিতিতে এক রঙিন মিলনমেলায় পরিণত হয় যেন। শিশুদের হাসিমুখ, অতিথিদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য আর ঐতিহ্যের আবেশে রঙে রঙে ভরে ওঠে দিনটি। স্বজনদের দুই দশকের পথচলার এ অধ্যায় যেন নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেয় একটাই বার্তা-মানবতার আলো ছড়াও, সৃজনের পথে এগিয়ে চল।
সভাপতি, স্বজন সমাবেশ, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)
