ভিনদেশে বাংলাদেশ
মানবিক গল্পের অগ্রদূত ওরা
জিনিয়া রহমান
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মনিটরের হালকা বিপ বিপ শব্দ ছাড়া লেবার রুমটি ছিল একেবারে নীরব। নিজ ঘর থেকে দূরে ভীত, নির্যাতিত এক গর্ভবতী তরুণী যার হাত ধরে ছিল অজানা কয়েকজন নারী। পরিবার বন্ধু-বান্ধব থেকে দূরে সেই তরুণীর সহযোগিতায় থাকা সেই নারীরা ছিল ভিকারুননিসা অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়া (VAAUS)-এর সদস্য। যা গঠিত হয়েছিল ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক কিছু ছাত্রীদের নিয়ে।
কোভিড-১৯ প্যানডামিকের সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল VAAUS-এর মমতাময়ী নারীরা। তারাই তার পরিবার হয়ে উঠেছিল। আর প্রয়োজনে পাশে ছিল আশ্রয় খুঁজে দেওয়া থেকে যত্ন-পুরোটা সময় জুড়ে।
স্কুলের স্মৃতি থেকে পরিবর্তনের আন্দোলন : ২০১৬ সালের অক্টোবরে, সিডনির এক রেস্টুরেন্টে ভিকারুননিসা অ্যালামনাইয়ের পুনর্মিলনে কয়েকজন নারী চিন্তা করেন কীভাবে তাদের এই শিকড়ের টানকে ভালোর শক্তিতে পরিণত করা যায়। ২০১৭ সালের মার্চে, এই ভিশন বাস্তবে রূপ নেয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় ভিকারুননিসা অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়া।
ডা. ইফাত আঞ্জুম, ডা. ফারিজা সাবরিনা, ফাদিয়া তাসনিম, ডা. সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান এবং তাসরিনা নাহিদ তন্নী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন এ সংগঠন। উদ্দেশ্য শিকড়ের এ বন্ধনকে সমাজসেবার শক্তিতে পরিণত করা। পরে ডা. মাহবুবা খানম মুক্তা ও ডা. সুরঞ্জনা জেনিফার রহমানের নেতৃতে সংগঠনটির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রেলিয়ান চ্যারিটিজ ও নট-ফর-প্রফিটস কমিশন (এসিএনসি)-এ নিবন্ধিত হয় এবং ডিডাকটিবেল গিফট রিসিপেন্ট (ডিজিআর) স্বীকৃতি অর্জন করে। ফলে এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে।
সাত বছরের সাফল্য : প্রতিষ্ঠার পর থেকে VAAUS অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি রাজ্য ও অঞ্চলে নারী, শিশু ও পরিবারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মর্যাদা রক্ষায় ১২টি সংগঠনকে ৪২ হাজার ডলার সহায়তা করে। ২০২২ সালে কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলসের ভয়াবহ বন্যায় তারা তৎক্ষণাৎ রেড ক্রসের মাধ্যমে ত্রাণ পাঠায়। তারা ‘শেয়ার দি ডিগনিটি’-এর সঙ্গে মিলে সংকটে থাকা নারীদের হাইজিন সাপ্লাইস সরবরাহ করে। অ্যাডিলেডে ‘লিটল হিরোস ফাউন্ডেশন’-এর জন্য দাতব্য ডিনার আয়োজন করে অসুস্থ শিশুদের সাহায্যে তহবিল সংগ্রহ করে। পার্থে ‘কিডস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’-এর জন্যও অর্থ সহায়তা দেয় শিশুস্বাস্থ্য গবেষণায়। এগুলো VAAUS-এর অসংখ্য কাজের একটা অংশবিশেষ যেখানে তাদের সব কার্যক্রমই সহমর্মিতাকে কাজে রূপ দেওয়ার অনন্য উদাহরণ।
অস্ট্রেলিয়ার সীমানা পেরিয়ে VAAUS বাংলাদেশে ‘এইম ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে অংশীদারত্বে অসহায় শিশুদের শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নেও কাজ করছে। দুটি দেশকে যুক্ত করেছে মানবিকতার বন্ধনে।
গল্পের মোড় ২০২৫ : নতুন অধ্যায় : ২০২৫ সালের ৯ নভেম্বর, সিডনির ল্যান্টানা ভেন্যুসে অনুষ্ঠিত হবে VAAUS গ্র্যান্ড রিইউনিয়ন ২০২৫, যেখানে যোগ দেবেন এক হাজারেরও বেশি অথিতি, তাদের মধ্যে ৩৫০ জনেরও বেশি সাবেক ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী। এ অনুষ্ঠানে উদ্বোধন হবে তাদের নতুন উদ্যোগ : ‘চেঞ্জ দি স্টোরি’, যার লক্ষ্য পারিবারিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি, সহানুভূতি জাগানো ও সমাজকে সম্পৃক্ত করা।
VAAUS বিশ্বাস করে পরিবর্তন শুরু হয় যখন নীরবতা ভাঙে, আর মানুষ একসঙ্গে কথা বলতে শেখে। বিশেষ করে পুরুষরা যখন নিরাপদ সমাজ গঠনে সহযোগী হয়। এ বছরের উদ্যোগে তারা সমর্থন করছে ‘আলো এনলাইটেড ওমেন’ এবং ‘কালচারাল ডাইভারসিটি নেটওয়ার্ক ইনক.(সিডিএনআই)’ দুটি সংগঠন যারা বিভিন্ন পটভূমির নারী ও অভিবাসী নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা যেখানে যায়, সেখানেই মানবতার আলো ছড়ায়। তাদের দেখে গর্ব হয়-কারণ শিক্ষা আর মমতা যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন তা সব সীমা পেরিয়ে সত্যিকারের পরিবর্তন আনে।’
VAAUS-এর ‘চেঞ্জ দি স্টোরি’ উদ্যোগকে সহায়তা করছে টাইটেল স্পন্সর ‘এআইএস মেরিন ইনভেটসমেন্টস’ যারা সমাজকল্যাণ ও টেকসই উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সংগঠনের বিশেষত্ব শুধু তাদের কাজেই নয় বরং তাদের মানবিক অবস্থানে। একটি বন্ধন, মমতা ও উদ্দেশ্যের সংমিশ্রণ। প্যানডামিকের সময় এক অসহায় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে VAAUS প্রমাণ করেছে ঢাকার এক ক্লাসরুমে জন্ম নেওয়া বন্ধন সীমান্ত পেরিয়েও পরিবর্তন আনতে পারে।
