Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

মানবসেবায় ভ্যালেরির এক জীবন

Icon

মতিউর রহমান ভান্ডারী

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৫ মাসের সফরে এসে অসহায়, দুস্থ রোগীদের সেবায় ৫৬ বছর ধরে বাস করছেন বাংলাদেশে। যুক্তরাজ্যের আয়েশি জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের দুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ভ্যালেরি অ্যান টেইলর। মানবসেবা করতে তিনি তার জন্মস্থান যুক্তরাজ্যের কেন্ট শহরে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ফেলে দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে বাস করছেন বাংলাদেশে। নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। ১৯৯০ সালে সাভারে পাঁচ একর জায়গায় পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন। এছাড়া দেশের পাঁচ বিভাগে ১৩টি শাখা রয়েছে সিআরপির। যেখানে বছরে প্রায় ৮০ হাজার রোগী সেবা নিতে পারেন।

যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ভ্যালেরি অ্যান টেইলর জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত ও তার সাফল্যের বিষয়ে বলেন, ‘১৯৬৭ সালে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির ওপর পড়াশোনা করে নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত করার জন্য ব্রত হই। ব্রিটিশ সরকারের ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজে (ভিএসও) আবেদনও করি। কিন্তু ন্যূনতম দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় ভিএসওতে নেওয়া হয় না। ফলে আমাকে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিতে যেতে হয় সেন্ট থমাসে। অভিজ্ঞতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই, স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দক্ষিণ এশিয়াতে কাজ করব। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝিতে সুযোগ আসে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার খ্রিষ্টান হাসপাতালে ১৫ মাসের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট হিসাবে কাজ করার। আমি তখন ভেবেছিলাম, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালোলাগবে না। বিমান থেকে নেমেই আমি চন্দ্রঘানার দারুণ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাই। একদিন নদীতে ঘন কুয়াশা ছিল। আশপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটি সাম্পান আমার চোখে পড়ে, মাঝি দাঁড় বাইছে, আর মনে হচ্ছে সাম্পানটি পানির দুই-তিন ফুট উপরে ভেসে চলছে। কারণ চারপাশে কুয়াশার মধ্যে শুধু সাম্পানটি দেখা যাচ্ছিল। সেই দৃশ্য এখনো পরিষ্কারভাবে আমার মনে ভাসে।’

ভ্যালেরি বলেন, ‘আমার বড় হওয়া ইংল্যান্ডের আলসবেরিতে, সেখানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনজুরি সেন্টারটি অবস্থিত। ছোটবেলায় আমি দেখেছি, লোকজন ওখানকার স্পোর্টস সেন্টারে খেলাধুলা করছে। হুইলচেয়ারে করে আশপাশের দোকানে লোকজন ঘুরছে; কিন্তু চন্দ্রঘোনায় কোনো হুইলচেয়ার ছিল না, কোনো কারিগরি শিক্ষা, অকুপেশনাল থেরাপির ব্যবস্থা ছিল না। তাই চন্দ্রঘোনার সৌন্দর্য আমাকে অবাক করলেও আমি বুঝতে পারি, এখানকার মানুষ কী পরিমাণ পিছিয়ে আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হয়। যুদ্ধ শেষ হতে তখনো মাস দুয়েক বাকি। আমি ফিরে আসি বাংলাদেশে। যুদ্ধের কারণে পঙ্গুত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় কাজের ক্ষেত্র বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময় বাংলাদেশে কাটানোর পর পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করতে ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যাই। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে মানবসেবায় কাটিয়ে দেই চার বছর। সে সময় আমি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম। অনেক প্রচেষ্টা এবং অপেক্ষার পর ১৯৭৯ সালে হাসপাতালের দুটো পরিত্যক্ত গুদাম ঘর পেয়ে প্রথমবারের মতো তিন-চারজন রোগী নিয়ে শুরু করি ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (সিআরপি)। প্রতিষ্ঠানটি উন্নত করতে সাইকেলযোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য চাই। এজন্য অনেক লাঞ্ছনাও সহ্য করতে হয় আমাকে। ১৯৯০ সালের আগেই তিনবার চিকিৎসা স্থান পরিবর্তন করতে হয়। পরবর্তীকালে সাভারে পাঁচ একর জায়গা কিনে পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি চালাতে গিয়েও অনেক বাধা পার করতে হয় আমাকে। নামে-বেনামে আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও নালিশ করা হয়েছে। শিশু পাচারের মতো অভিযোগও আনা হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলাদেশের কিছু লোকজন কাজ করতে পছন্দ করে না, অন্য কেউ যদি কাজ করে, তাকেও তারা পছন্দ করে না। এরপর সিআরপির নিজস্ব উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি করা হয় হুইলচেয়ার।’

কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে গিয়ে সংসার নামক শব্দটি ভুলে গেছি। তবে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও পঙ্গু দুজন মেয়েকে দত্তক নিই। তাদের নাম জয়তি ও পপি।’ তাদের দুজনকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন ভ্যালেরি। তাদের মধ্যে জয়তি সিআরপিতে কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। পপির শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়ায়, তিনি ভ্যালেরির সঙ্গেই থাকেন।

ভ্যালেরি টেইলর ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান। ১৯৯৫ সালে কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ব্রিটিশ সরকার তাকে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি হিসাবে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। এছাড়া ২০২৫ সালে ব্রিটিশ রাজার সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশে সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডের (সিআরপি) প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি টেইলর। মানবসেবাই তার লক্ষ্য, দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো তার উদ্দেশ্য। একজন ভ্যালেরি টেইলর, একজন স্বেচ্ছাসেবী বদলে দেন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, বদলে দেন জীবন। বাকি জীবন তিনি বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও পঙ্গু মানুষের সেবা করেই কাটিয়ে দিতে চান তার এক জীবন।

ভ্যালেরি অ্যান টেইলর

প্রতিষ্ঠাতা : পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম