নারীর জন্য কতটা নিরাপদ গণপরিবহণ
রুকাইয়া সাওম লীনা
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কেস স্ট্যাডি ১
নাদিয়া প্রতিদিন বাসে অফিসে যাতায়াত করে। প্রতিদিনই যাতায়াতের পথে কোনো না কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সে। সব ঘটনাই তেতো হয়ে মনে জমা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি যে ঘটনাটা তাকে ব্যথিত করে তা হলো তার ছোটবেলার একটি ঘটনা। তার বাবা পরিবহণ সেক্টরে কাজ করতেন। সেই সুবাদে সেখানকার অনেককেই সে চাচা বলে ডাকত। একদিন পরিবারের সবাই মিলে বাসে দূরে কোথাও ভ্রমণের সময়, তার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তাকে হাত ধরে গাড়িতে তুলছে এমন সময় তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দিল। সেদিন নাদিয়া এতটাই চমকে গিয়েছিল যে, কান্না করতেও ভুলে গিয়েছিল। এই ট্রমা কাটতে তার বহুদিন লেগেছে।
কেস স্ট্যাডি ২
সীমা তখন কলেজে পড়ে। কলেজে যাওয়ার পথে বাসে, একজন এসে তার কাঁধ বরাবর দাঁড়াল গা ঘেঁষে। তারপর একটু পরপর গুঁতা দিতে থাকল তার কাঁধে। কলেজ পর্যন্ত পুরো রাস্তায় সে ভয়ে-লজ্জায় কথা বলতে পারল না একটুও। সেদিন কলেজে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিল সে।
কেস স্ট্যাডি ৩
অনুপমা বাসের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল নিউমার্কেট ও পরে ঢাকা কলেজের সামনে। কিন্তু কোনো বাসই তাকে তুলল না, সিট নেই সিট নেই বলে। তারপর সে হেঁটে সায়েন্সল্যাবে এসে আবারও চেষ্টা করল। সে নিচ থেকে দেখতে পাচ্ছিল মহিলা সিটে পুরুষ বসে আছে, কয়েকবার ড্রাইভারের সহকারী তাকে তুলতে চাইলেও পুরুষ যাত্রীরা তাকে তুলতে দেয়নি। সেদিন সে দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল।
গণপরিবহণে এমন ভোগান্তি-অপমান যেন নারীর জন্য নৈমিত্তিক বিষয়। এর যেন কোনো সমাধান নেই। এ আধুনিক যুগে এসেও নারী গণপরিবহণে এমন হেনস্তার শিকার হবেন এটা ভাবা যায় না। তবু আমাদের ভাবতে হচ্ছে, নীরবে মেনেও নিতে হচ্ছে। নারীর অধিকার বা নারীর সম্মান নিয়ে আমরা সভা-সেমিনার করি, বড় বড় পরিকল্পনা করি কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটুকু এ নিয়ে খুব একটা ভাবি না আমরা। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন কর্মক্ষেত্রে কাজ করেন নারীরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় নারী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ঘর থেকে বের হয়ে কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত যেতে যে পথ, সে পথ নারীর জন্য আজও নিরাপদ নয়। নারীর জন্য নিরাপদ গণপরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। ফলে রোজ হেনস্তার কতশত ঘটনা ঘটছে তার হিসাবও নিই না আমরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বলেন, ‘বাংলাদেশের গণপরিবহণ নারীর জন্য একদমই নিরাপদ নয়। বাংলাদেশে একটি বাসের কথা বলতে পারবেন যেটি শুধু নারীর জন্য চলে। গণপরিবহণ সেটি বাস হোক, সিএনজি হোক, উবার হোক বা পাঠাও; মোট কথা হলো কোনো পাবলিক পরিবহণই মেয়েদের জন্য নিরাপর নয়। বিকল্প যদি ধরেন মেট্রোরেল, তাও কি নারীদের জন্য নিরাপদ, এতে খুবই ভিড় হয়। তিল ধারণের জায়গা থাকে না, দাঁড়িয়ে ঝুলে ঝুলে যেতে হয়, কিছু পুরুষ অযথাই ওই সুযোগে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়, গায়ে এসে পড়ে। কাজেই গণপরিবহণে নিরাপত্তা নারীদের চিরদিনের সমস্যা। এর মধ্যে রিকশাটা একটু ভালো বলা যায়। তবে আমার মনে হয় শুধু মেয়েদের জন্য আলাদা একটা বাস সার্ভিস থাকলে ভালো হবে। সেখানে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও ড্রাইভারের সহকারীও নারী হলে ভালো হয়। তাহলে গণপরিবহণ নারীদের জন্য সহনশীল হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। বাসে, মাইক্রোবাসে এমনকি পাঠাও শেয়ারিং বাইক রাইডেও নারী ধর্ষণের শিকার হন। অফিস কর্তৃপক্ষ নারী কর্মীদের জন্য পৃথক যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারেন। অন্যদিকে নারীরা বাইসাইকেল ব্যবহার করতে পারেন। এটি আবার পরিবেশবান্ধবও। মানুষের যদি বিবেক জাগ্রত হয় তখন এমন ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু যতদিন পুরুষ সমাজের বিবেক জাগ্রত না হবে ততদিন এরকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে থাকবে। আমি মনে করি ছোটবেলা থেকে এ বিষয়ে বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে হবে। তাদের পাঠ্যবইতে এ বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। গণপরিবহণে একজন নারীর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করতে হবে তা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ ও পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া বাস মালিক সমিতি যদি তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করতে পারে তবে এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশা রাখি। পাশাপাশি আছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যারা আরও সচেষ্ট হলে এ রকম ঘটনা হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহজাবীন রব্বানী তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সবচেয়ে নিরাপদ ও স্বল্প সময়ে যাতায়াতের জন্য মেট্রোরেল নারীদের জন্য একটি আশীর্বাদ। যদিও ভিড়ের কারণে এখানেও নারীরা পুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের শিকার হন। নারীরা চাইলেও নিরাপদ ও স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারতেন খুবই কম। মেট্রোরেল হয়তো অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা তো রয়েই গেছে। গণপরিবহণে বিশেষ করে লোকাল বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ সিটেও বসার জন্য নারীদের প্রতিনিয়ত ফাইট করতে হয়। ইদানীং তো সংরক্ষিত আসন ব্যাপারটা নাই হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে কালসি হয়ে মিরপুর বারো নম্বর যাওয়ার পথে একটি লোকাল বাসে উঠতে গিয়ে দেখি মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনের পাশের টানা লম্বা চার আসনের সিটই শুধু বরাদ্দ। বাকিগুলোতে বসার সেভাবে সুযোগ নেই। আর কেউ বসতে চাইলেও সারাক্ষণ সচেতন থাকতে হয় পাশের পুরুষ যাত্রীকে নিয়ে। কারণ বাসের সিটগুলো এতটাই সংকীর্ণ যে, সেখানে দুজন অপরিচিত মানুষের পাশাপাশি বসে যাওয়া কঠিন। আর সেক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের দুজনের পাশাপাশি বসে যাওয়াটা তো আরও বেশি কঠিন, যদি না পাশের পুরুষ যাত্রী নারী যাত্রীর প্রতি সংবেদনশীল না হন। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই সহযাত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে হয় নারী যাত্রীদের। সবাই আবার ভোকাল হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে পাশের পুরুষ যাত্রীর অশোভন আচরণ অনেক সময় নারী যাত্রীটিকে চুপচাপ সয়ে যেতে হয়। অনেক সময় বাসে পেছনের সিটে বসা পুরুষও সাইড থেকে হাত দিয়ে নারী যাত্রীদের শরীরের সেনসেটিভ জায়গায় হাত দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা চালায়। এসবই যারা প্রতিনিয়ত বাস-ট্রেনে যাতায়াত করেন তাদের প্রত্যেকের নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা। জরিপ চালালেই দেখা যাবে সবার জীবনের ঘটনাগুলো একই রকম। আমার মনে আছে, আগে যখন মোহাম্মদপুর থেকে পল্টনের বাসে নিয়মিত যাতায়াত করতাম, তখন নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও সেসব আসনে বসার জন্য মেয়েরা রীতিমতো ফাইট করতেন। নানা কটূক্তি শুনতে হতো তাদের। একটা তো ছিল খুবই কমন, সমঅধিকার চান আর বসার সময় আলাদা সিট দরকার আপনাদের! পাশের সিটে বসা পুরুষ যাত্রীকে নারী যদি সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে বসার অনুরোধ করেনও তাহলেই নারীটিকে শুনতে হয়, এতই যদি আপনার অসুবিধা তাহলে প্রাইভেট গাড়িতে চলাচল করলেই পারেন। কিন্তু পুরুষ যারা তারা ভুলেই যান, যে কোনো গণপরিবহণে যাতায়াতের সময় প্রত্যেকেরই কিছু কিছু আচরণ সচেতনভাবেই করা বাঞ্ছনীয়, আপনার কোনো আচরণে বা কথায় পাশে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি যেন ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত না হন তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু আমার বা আপনার। আমাদের দেশে এসব নিয়মকানুন একেবারেই মানেন না কেউ। আর নারী কেউ আপনার সহযাত্রী হলে অধিকাংশই তাদের প্রতি যে আরেকটু বেশি সংবেদনশীল হতে হয় তাও জানেন না। আসলে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়তই নারীকে তার অবস্থা ও অবস্থানের জানান নিজেকেই দিতে হয়। তার প্রাত্যহিক নিরাপত্তার জন্য নিজেকেই বেশি মনোযোগী হতে হয়। চলাচলের পথে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। একটু অসচেতন হলেই আশপাশের সবাই সুযোগ নেওয়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত।’
পরিত্রাণের উপায়
* মানবিক মূল্যবোধের চর্চা করা।
* নারীদের প্রতি সদয় হওয়া, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও সম্মান করার চর্চা করা।
* সামাজিকভাবে নারীর প্রতি অবিচার ও ঘৃণা রোধ করতে সচেষ্ট হওয়া।
* সামাজিকভাবে নারীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তার শিক্ষা কার্যকর করা।
* পাঠ্যসূচিতে গণপরিবহণে নারীর সঙ্গে ব্যবহার বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আরও সচেষ্ট হতে হবে।
* বিভিন্ন মিডিয়া, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
