মদিনার ইসলাম এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতা
আবু সায়েম
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মদিনা’ নিয়ে রাজনীতির মানে কী?
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যে দলই পাক, যেভাবেই পাক-‘মদিনার ইসলামে’ কেউই দেশ চালাবে না। নির্বাচন সামনে রেখে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি বা প্রচারণাও নেই। তবু দেখা যায়, ‘মদিনা’ মাঝে মাঝে বিএনপি ও এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কারও কারও রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
‘মদিনা সনদ’ মানবজাতির এক অনন্য দলিল। এটি ছিল বহুমাত্রিক সমাজে সহাবস্থানের এক সামাজিক চুক্তি-ধর্মীয় আইন প্রতিষ্ঠার কোনো ঘোষণা নয়। বিশ্বনবী (সা.) মুসলিম ও ইহুদিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রের মানুষের শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সনদের প্রাসঙ্গিকতা আজও অটুট। কিন্তু এটিকে শরিয়া আইনের প্রতিচ্ছবি হিসাবে রাজনৈতিক স্লোগানে ব্যবহার করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উদ্বেগজনক।
তাহলে ‘মদিনা’ ও বিএনপিকে নিয়ে এ টানাহেঁচড়ার মানে কী? ধর্মকে পুঁজি করে বিএনপির জনপ্রিয়তা খর্ব করা? বিএনপি তো ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের প্রতিপক্ষ নয়। মদিনার ইসলাম নিয়ে দলের অবস্থান না বুঝতে পারা রাজনৈতিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বটে, তবে এ নিয়ে অপরাজনীতির সুযোগ নেই। এখন মানুষ সচেতন-তারা কথা নয়, নীতি ও কর্মফলকেই বিচার করে।
জনগণের হৃদয়ে স্থান পেতে হলে আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে লক্ষ্য-ক্ষমতার ভাগ নেওয়া, নাকি মানুষের সেবা করা। যদি লক্ষ্য হয় জনকল্যাণ, তবে চাতুর্যনির্ভর রাজনীতি নয়; প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্ব ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শনে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা রক্ষাকে রাষ্ট্রনীতির মূল বলা হলেও নেলসন ম্যান্ডেলার সাফল্য ছিল নৈতিকতা ও আদর্শের রাজনীতি। ‘The Prince’ আমার পছন্দের গ্রন্থ নয়। আমাদের এ ভূখণ্ডে শহীদ জিয়া আদর্শিক রাজনীতির পথেই মানুষের মন জয় করেছিলেন-যার পুনরাবৃত্তি আজ জরুরি। কপটতা, শঠতা, ঘ্যানঘ্যান ও বাগাড়ম্বর মানুষ এখন গ্রহণ করে না।
‘কে মদিনা সনদে দেশ চালাবে’ বা ‘কে ইসলামি আইন শতভাগ বাস্তবায়ন করবে’-এসব নিছক দলীয় এজেন্ডা। আসল প্রশ্ন হলো-এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা কতটা কার্যকর ও সময়োপযোগী? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, মুসলিম শাসকরা প্রশাসনিক সংস্কার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ধর্ম ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন। বিএনপিকে যারা ‘মদিনা’র মুখোমুখি করতে চায়, তারা নিজেরাও মদিনার ইসলাম নয়, মদিনা সনদের চেতনাও অনুসরণ করে না-সরকারে গেলেও করবে না।
মানবিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মীয় নীতির অনুপ্রেরণা অবশ্যই থাকতে পারে, তবে তা হতে হবে যুক্তিসংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সর্বজনীন। জাতিসংঘ সনদ (UN Charter) বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (Universal Declaration of Human Rights) ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। আমি মনে করি, ধর্মীয় ও জাগতিক আইনের ভারসাম্যমূলক প্রয়োগেই কল্যাণকর নেতৃত্ব সম্ভব।
ফাঁপা বুলি বা ভুজুংভাজুং রাজনীতির মৃত্যু ঘটায়। যারা সত্যিই দেশ ও রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের চিন্তা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সততাই বলে দেবে-তারা ইতিহাসে স্থান পাবে, নাকি শুধু রঙ্গমঞ্চের চরিত্র হয়ে থাকবে।
আমরা যাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই, তাদের শেখার ও আত্মশুদ্ধির যাত্রা অব্যাহত থাকা জরুরি। উদার মানসিকতা ও নৈতিক দৃঢ়তা ছাড়া নেতৃত্ব পরিণত হয় কর্তৃত্বে-সেখানেই জন্ম নেয় ফ্যাসিজম। রাজনীতির মূল শক্তি হতে হবে জনগণের ভালোবাসা; ক্ষমতার লোভ নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা মানে ক্ষমতা নয়, বরং দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা।
আমি বিশ্বাস করি, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা দেশপ্রেমিক ও পরিবর্তনের প্রত্যাশায় উদ্বুদ্ধ। তবে তাদের ভেতরে যেন অনৈতিকতা, প্রতিহিংসা বা স্বার্থপরতার রাজনীতির শেকড় না গজায়-এটাই কাম্য। নৈতিক ভিত্তি হারালে যে কোনো আন্দোলনই দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নে যারা বিশ্বাসী-তাদের মধ্যে মুছে যাক বিভাজন ও ভুল বোঝাবুঝি। ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সততা, ন্যায়, মানবিকতা ও আদর্শিক রাজনীতির আলোকবর্তিকায়।
ব্যারিস্টার আবু সায়েম : আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিবিদ
