গণতন্ত্রে সহজাতভাবেই দূর হয় ফ্যাসিবাদ
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কথায় কথা বাড়ে, এক কথায় দশ কথা হয়, এরপর কোনটি কথা আর কোনটি বাতুলতা, তা খুঁজে পাওয়া ভার। কে বলে, কে বলে না, সেটাও পাওয়া যায় না, তবে কথা থাকে। তার রেশ শেষতক যা হওয়ার তাই হয়। বলছিলাম বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতা নিয়ে। চারদিকে কথার তুবড়ি। যে যেদিকে পারছে, যেমনই পারছে, বলছে। সত্যি বলতে কী, এসব বলার কোনো উদ্দেশ্য নেই, তা নয়। সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় সামনে রেখেই হয়তো যারা বলছেন, তারা সে কাজটি করছেন। আসলে আমরা কেউ কেউ পূর্বাপর না ভেবেই, যে যেমনই পারছি, বলছি, আক্রমণ করছি। এখন সবাই নির্বাচনি উত্তাপে রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ উত্তাপ কতটা কী ধরনের এবং কতমাত্রার, সে নিয়ে রয়েছে নানা কথা। কথা হচ্ছিল, ঐকমত্য কমিশন থেকে আসে-গণভোট না নির্বাচন আগে। অনেক কথা হচ্ছে, বিএনপি বলছে, গণভোট হবে জাতীয় নির্বাচনের দিন, কেউ বলছে, এটি হতে হবে নির্বাচনের আগে। কেন এবং কী কারণে-এসব ব্যাখ্যা নতুন করে দিয়ে কোনো লাভ নেই। ডিম আগে না মুরগি আগে-এ আলোচনায় বিশ্বাসীদের জন্য হয়তো একটি ফয়সালা রয়েছে। কারণ, তারা মনে করেন, প্রতিটি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে। সে বিবেচনায় আগে মুরগি, পরে ডিম। কিন্তু যদি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চান, তাহলে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। কারণ, শেষ কথা এটাই হবে-ডিম না এলে মুরগি কোত্থেকে? আর মুরগি না এলে ডিম কোত্থেকে এলো? যেমনি বোঝানো যাবে না ‘ঢুপ করিয়া পড়িল, না পড়িয়া ঢুপ করিল।’ কথা যাই হোক, মুরগি ও ডিম যেমন সত্যি, তেমনই পড়ার শব্দও বাস্তব। কে কীভাবে মানল, সেটি বড় কথা নয় এবং এ মানা-না-মানার কারণে বাস্তবতায় কোনো পরিবর্তন নেই। সে কথাই বর্তমান সময় নিয়ে।
বর্তমান সরকারকে নির্দলীয় বলা হয়। আসলে নির্দলীয় বলে কিছু নেই। খানিকটা সময়ের জন্য দলনিরপেক্ষ বলা গেলেও একসময় তা দলীয়তেই রূপান্তরিত হয়। কারণ, যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন, তারা কোনো না কোনো দলকে ভোট দিয়ে থাকেন। এ ভোট দেওয়াটা দলের আনুগত্য মনে করা হয়। বড়জোর একটি শব্দ ব্যবহার করা যায়, তাহলো দলকানা। এ শব্দটি অর্থাৎ সবকিছু অন্ধের মতো মেনে না নেওয়া। এ বিষয়টি অনেক বেশি বিস্তৃত। আমাদের অতীত প্রমাণ করে, দেশের রথী-মহারথীরাও এর থেকে বাইরে থাকেননি। ধরুন বাকশালের কথাই, যখন যোগদানের কথা উঠল, তখন দেশের কথিত জ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী-লেখকসহ দেশের আমলা-কামলা সবাই দলবেঁধে কে কার আগে খাতায় নাম লেখাবে, গণভবনে গিয়ে চেহারা দেখাবে, তার প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল। আবার যখন বাকশালের পতন হয়, তখনো দেখা গেল কে কেন কোন বাধ্যবাধকতায় যোগ দিয়েছিল, তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় নেমে গেলেন। ব্যাপারটা কেন ঘটে এর একটি সহজ ব্যাখ্যা হলো-আমরা মেরুদণ্ড সোজা করতে শিখিনি। গরিব দেশের অর্থনৈতিক বৃত্তবলয় না থাকায় আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো মোহে ছুটছি। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেওয়ার এ অসম প্রতিযোগিতার এক মচ্ছব পড়েছিল বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে। আমাদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্বৃত্তরা উন্মাদনায় মেতে ওঠে। এখন শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতাকে স্থায়ী রূপ দিতে কীভাবে জাতীয় অর্থের অপচয় হয়েছে। ক্ষমতার চাবি ঘুরিয়ে সাধারণ মানুষকে কতটা নির্যাতন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো জনগণ আরও জানবে। সে কথা ধরেই বলছি, আগস্ট বিপ্লবের পর যে নির্দলীয় সরকার জাতির দায়িত্বভার গ্রহণ করল, এখন তাদের বিরুদ্ধে দলীয় কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে এবং এ অভিযোগ এক-দুজনের ব্যাপারে নয়, একেবারে আটজনকে নিয়ে। কথাটা খুব ছোট নয়। কেন এবং কীভাবে এরা দলীয় কাজে ঢুকে গেলেন তা নিয়ে কথা আছে, সে কথায় যাওয়ার জো নেই, যাচ্ছিও না। এটা সত্যি, জনগণ প্রত্যক্ষ করছে বর্তমান সরকারের দুর্নীতি রোধে যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, এর বিপরীতে তাদের আগ্র্রহ অন্যদিকে বেশি। বোধকরি এ আগ্রহের নামই দলীয়প্রবণতা। এর একটি কারণ নিয়ে জনমনে ব্যাপক ধারণা রয়েছে, তা হলো আগামী নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় যাবে, সেটি আগে থেকেই কেউ কেউ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। ব্যাপারটি যদি সেরকম হয়, তাহলে সেটি ফ্যাসিবাদের নীলনকশার বাইরে ভাবার কোনো কারণ নেই। যে কাজ আওয়ামী করলে দোষ, সেটি অন্যরা করলে পুণ্য হবে বা জান্নাতে যাওয়া যাবে, সে ধারণা সঠিক নয়, বরং দোষকে দোষ স্বীকার করাই হচ্ছে সততা। বোধকরি এ মানদণ্ডে বিচার করলে বিএনপি যে নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক মুডে সরকারকে যেতে বলেছে, এর কোনো বিকল্প নেই। এটি সংবিধান স্বীকৃত পদ্ধতি। তত্ত্বাবধায়ক নির্দলীয় নয়। বিভিন্ন দলের মনোনীতরা জাতীয় দায়িত্ব পালন করে জাতি উদ্ধারের মহান ব্রত পালন করেন। এর ফলে একটি ভারসাম্য তৈরি হয়, যা সবাই আস্থা লাভ করে। এ আস্থার জায়গায়ই আওয়ামী লীগের আপত্তি ছিল। আর সে কারণেই নিজেদের মতো করে তারা সবকিছু দখলে নেমেছিল। গোটা জাতিকে বোকা বানাতে গিয়ে শেষমেশ নিজেরাই জনতার উত্তাপে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বিষয়টি আস্থার সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন হচ্ছে একটি গভীর আস্থার ব্যাপার। এখানে জয়-পরাজয়ের হিসাবের মারপ্যাঁচ যাই থাকুক, জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে, আসলে সরকার যা বলছে তা ঠিক। সরকার ব্যাপারটি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত মনে করে সরকার সত্যি কথা বলে না। যে কোনো কারণেই হোক, সরকার একটি নির্যাতকের ভূমিকায় থাকে। সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতেই রাজনৈতিক আস্থার ব্যাপারটি আসে। এজন্যই রাজনীতিকদের আলোচনা। এত আলোচনা জুলাই সনদ নিয়ে। দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে, কথা হয়েছে, অথচ বাস্তবে দেখা গেল বিএনপি বলছে সরকার প্রতারণা করেছে। তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, যেভাবে বলেছে, সরকার সেভাবে করেনি। তাদের নোট অব ডিসেন্ট গৃহীত হয়নি। এর আগে এনসিপি স্বাক্ষর করেনি। জুলাই সনদ নিয়ে মৌলিক যে বিতর্ক, এর মূল কথা হচ্ছে-এ সনদ যারা তৈরি করেছেন, তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। বাস্তবায়ন যারা করবেন, তারা সব বিষয়ে একমত নন। এর কারণ, সনদ তৈরিতে গোড়ায় কিছু বিষয় রয়েছে। যারা করেছেন, তাদের এখতিয়ার নিয়ে। আজ ১৫-১৬ মাস হয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকারের মেয়াদ। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের প্রকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলা যায়, তাহলে বলতে হবে, মাত্র কয়েক মিনিটের আলোচনা করে প্রথম ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল জাতীয় সংসদের নাম বাকশাল। এরপর দ্বিতীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল ’৮২ সালে সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে। দুটোর প্রকৃতি আলাদা। সেদিন যদি সংসদে সংসদ-সদস্যরা জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, আবদুল্লাহ সরকারের মতো জোর কণ্ঠে বলতে পারতেন ‘না’, তাহলে দৃশ্যপট পালটে যেত। আমরা ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর ভাষার অধিকারের ক্ষেত্রে বলেছিলাম ‘না’। সেই না জন্ম দিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। সংসদে যদি একটি না বলা যেত, বাংলাদেশ বেঁচে যেত ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে। সৃষ্টি হতো নতুন ইতিহাস। অনুরূপভাবে সেনাপ্রধান এরশাদ যখন সামরিক শাসন জারি করতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছিল, তখন স্পিকার যদি সংসদ-সদস্যদের আহ্বান জানাতে পারতেন, যদিও তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন, সংসদ ডেকে দেব, আসলে তা হয়নি, তাহলে নয় বছর জাতি ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেত। ২০০৮ সালে যদি পাতানো নির্বাচনের ফাঁদে কোনো কোনো দল পা না দিত, তাহলে জাতি গত সাড়ে পনেরো বছর বোধকরি পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতনের অভিজ্ঞতা লাভ করত না। এ তিনটি ফ্যাসিবাদ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া জরুরি ছিল। আসলে আমরা তা নিয়েছি কি না, সে প্রশ্ন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। কথা এ কারণে, অবশেষে বলা হলো দলগুলো নিজেরাই ঐকমত্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সপ্তাহখানেকের সময় বেঁধে দিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান উড়াল দিলেন। তিনি তো জিয়াউদ্দনি বাবলু নন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে স্বৈরাচারের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব আলোচনা করেছে, তার মর্মার্থ অনুধাবনে তারা সক্ষম হয়েছেন বলে মনে হয় না। সরকারের অবস্থা নিয়ে বোধকরি তাদের মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। এটি এমন এক সরকার, যার ভিত্তি নানা বিবেচনায় বিবেচিত হতে পারে। সরকার শপথ নিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে সংবিধান সংরক্ষণে, অথচ সংবিধানে নির্দলীয় সরকার বলে কিছু নেই। একটি সংসদ থেকে অন্য সংসদের মেয়াদ পর্যন্ত সংসদীয় রীতিতে স্পিকার বহাল থাকার কথা, সেটি নেই। সরকারের একমাত্র ভিত্তি হলো তারা জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত হয়েছে। মূলত দৈনন্দিন কাজ চালানোর সরকার বলা চলে। এ ধরনের সরকারের পক্ষে যে কোনো বিবেচনাতেই গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। যে শক্তি তার রয়েছে, সেটি হলো জনতার শক্তি। আমরা যদি এ সরকারকে জেনারেল উইলের সরকার বলি, তাহলে কিছুদূর হয়তো এগোতে পারি। প্রশ্ন থেকে যাবে, আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সংসদের। সংসদ না থাকলে সে দায়িত্ব পালন করবেন রাষ্ট্রপতি। এখন যেসব প্রশ্ন উঠেছে, এর গুরুতর ব্যাখ্যা আইনবিশারদরা দিচ্ছেন। সব ব্যাখ্যাই যে গ্রহণযোগ্য, তেমনটা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে একটি বিষয় বোধহয় বলা যায়, তা হলো যে ঐক্যের সূত্র ধরে এ সরকার, সে ঐক্য, সে অবস্থায় বহাল নেই।
কনভেয়ারবেল্ট প্রপেলারের সঙ্গে যুক্ত করলে সামনের ও পেছনের উভয় চাকা ঘুরতে থাকে। গণতন্ত্রে নির্বাচন হচ্ছে সেই বেল্ট, যা চালু হলে এবং চালু রাখতে পারলে স্বৈরাচার আপনাতেই বিদায় হয়। খোদ পশ্চিমবঙ্গসহ ইউরোপের বহু দেশে বামপন্থিরা ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। আমাদের দেশে গণতন্ত্র চালু রাখা গেলে ফ্যাসিবাদ আপনাতেই দূর হতে বাধ্য। আজকের প্রেক্ষাপটে সেটি কতটা করা যাবে, তা নিশ্চিত করাই মূল বিষয়। সেদিকটায় নজর দিলে বা দেওয়া গেলে কথার বিস্তৃতি থামবে, দশ কথাও হবে না, মানুষ আশ্বস্ত হবে। সব জটিলতার নিরসন হবে।
আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সিনিয়র সাংবাদিক কলামিস্ট
