Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক : বিভ্রান্তির সুযোগ নেই

Icon

কারাম নামা

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক : বিভ্রান্তির সুযোগ নেই

ছবি: সংগৃহীত

ইসরাইলের প্রবাসীবিষয়ক মন্ত্রী অ্যামিচাই চিকলি নিউইয়র্কের মেয়র হিসাবে জোহরান মামদানি নির্বাচিত হওয়ায় যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক ভুল ধারণার একটি পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ। চিকলি কেবল ইসরাইলের উদ্বেগই প্রকাশ করেননি, তার সতর্কবার্তা-‘নিউইয়র্ক খোলা চোখে সেই অতল গহ্বরের দিকে হাঁটছে, যেখানে লন্ডন ইতোমধ্যেই পড়ে গেছে’-সেই একই কট্টর ডানপন্থি বক্তব্যের প্রতিধ্বনি, যা সাদিক খান লন্ডনের মেয়র পদে জয়ী হওয়ার সময় আমরা শুনেছিলাম।

এখনো কিছুই ধসে পড়েনি। লন্ডন তার বহু সাংস্কৃতিক কাঠামো ধরে রেখেছে, প্রায় প্রতিটি বিশ্বাসকে গ্রহণ করেছে। সাদিক খান কখনোই শুধু শহরের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করেননি। মামদানির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। নিউইয়র্ক কোনো অতল গহ্বরে পড়বে না, ঠিক যেমন লন্ডন পড়েনি। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা-‘মামদানিকে সমর্থনকারী যে কোনো ইহুদি ভোটার একজন নির্বোধ’-আমেরিকান রাজনৈতিক ভূখণ্ডের উপর ভেসে থাকা বিষাক্ত ধূলিকণায় পরিণত হবে।

বিভিন্ন রাজ্য ও পৌরসভা অফিসে নির্বাচিত হওয়া কমপক্ষে আরও ৩৮ জন মুসলিম প্রার্থীর সঙ্গে মামদানির বিজয় একটি গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মুসলমানরা আর আমেরিকান শহরগুলোর প্রান্তে নেই; তারা সেগুলোকে আকার দিচ্ছে, তাদের সর্বোচ্চ পদগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা করছে এবং নাগরিক পরিচয়কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। মামদানির নির্ভীকতা এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী বিতর্কে যুক্ত না হওয়ার দৃঢ়তা এই রূপান্তরের ক্ষেত্রে তার ভূমিকাকে নির্ধারিত করেছে। বিজয়ী ভাষণে মামদানি বলেছেন, ‘আমি মুসলমান, বা তরুণ, বা একজন গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করছি।’

‘নির্বুদ্ধিতা’ নিয়ে ট্রাম্পের জনতুষ্টিবাদী বক্তব্যে মুসলমানদের কীভাবে দেখা হয়, সে সম্পর্কে একটি গভীর পশ্চিমা ভ্রান্তি প্রকাশ পেয়েছে, যদিও তারাই সেই শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী, যেগুলোর নেতৃত্ব দিতে তারা এখন সাহায্য করছে।

আমি একবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, যিনি অদ্ভুত সরলতার সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন, আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতিতে আরব বিশ্বে কী ঘটছে সে সম্পর্কে প্রায়ই কোনো বাস্তব ধারণা থাকে না। এই বিশেষ কর্মকর্তা লিবিয়া সম্পর্কে অসাধারণ সাবলীলতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন-এর উপজাতীয় কাঠামো, এর উপনিবেশবিরোধী প্রতিরোধ, এমনকি আলী সিদকি আবদ আল-কাদিরের কবিতা এবং ইব্রাহিম আল-কোনি ও সাদিক আল-নায়হুমের উপন্যাস নিয়েও। যখন আমি কথোপকথনটি ইরাকের দিকে নিয়ে যাই, তখনো তিনি থেমে যাননি। মনে হচ্ছিল, তিনি কোনো ব্রিফিং মেমো থেকে নয়, বরং একটি নিজস্ব নোটবুক থেকে পড়ছেন।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : ‘আপনার মতো কতজন কর্মকর্তা পররাষ্ট্র দপ্তরে আছেন?’ তিনি উত্তর দিলেন : ‘দুর্ভাগ্যবশত, বেশি নেই।’

এরপর আসা যাক তুরস্কে নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জোসেফ বার্টনের কথায়। তিনি একটি গভীর সংকট উন্মোচন করলেন : বিবেকের সংকট। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বার্টন লিখেছেন : ‘যখন আমি আঙ্কারায় মার্কিন দূতাবাসে কনস্যুলার অফিসার হিসাবে কাজ শুরু করি, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সব দিককে আমি পছন্দ করতাম না। তবে আমি প্রত্যেক ভিসা আবেদনকারীকে

ন্যায্যভাবে বিবেচনা করতে এবং আমেরিকান স্বপ্নের সন্ধানে মানুষকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। এরপর এলো মুসলমানদের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা।’

হঠাৎ করেই তার রুটিন কাজ একটি নৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়। তিনি আর স্বপ্নের পথ তৈরি করছিলেন না-তিনি বিশ্বাসের ভিত্তিতে সেগুলোকে অস্বীকার করছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার পদত্যাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সেই আত্মতুষ্টি এবং ঔদ্ধত্যকে প্রতিরোধ করা, যার মাধ্যমে আমেরিকা মুসলমানদের ‘অন্য’ হিসাবে বিবেচনা করে।’’

বার্টন বিশ্বাস করেন, একই অবস্থানে থাকা জুনিয়র কূটনীতিকরা বিতৃষ্ণা অনুভব করবেন এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ এ ব্যবস্থাকে ঠিক করবে না। এদিকে, সিনিয়র কর্মকর্তারা জাতীয় বিবেকের ওপর আরও একটি দাগ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবেন।

বার্টন, যিনি ভারত ও তুরস্কে কাজ করেছেন, তিনি পদত্যাগ করেছিলেন; কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভেতর থেকে একটি বর্ণবাদী রাজনৈতিক প্রকল্পকে প্রতিরোধ করা ক্ষমতার উৎসের সঙ্গে একটি লোকসানি দরকষাকষির মতো।

আমরা তার মতো বেশি লোক খুঁজে পাব না। কিন্তু এটি কেবল ভুল বোঝার বিষয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যের বিষয়, যা নিজেকে মানবজাতির ঊর্ধ্বে মনে করে।

আমাদের উদাহরণের অভাব নেই। চিকলির কল্পিত অতল গহ্বর থেকে শুরু করে ট্রাম্পের অপমান পর্যন্ত সাংস্কৃতিক শত্রুতা একটি বাস্তব বিষয়। এটি একটি সস্তা কল্পনা, যা পরিচয়কে হুমকির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে-এমন একটি কল্পনা যা মামদানির উত্থানের প্রতিক্রিয়ার চারপাশের বিষাক্ত বক্তব্যকে ইন্ধন দেয়। কিন্তু তার প্রচারণার পেছনে সমবেত ৫০ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবকের কাছে মামদানির প্রার্থীপদ আরও অনেক বড় কিছু বোঝায়। তাদের কাছে তিনি আশার আলোকবর্তিকা-এমন একসময়ে যখন আমেরিকায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দিগন্ত দিন দিন অন্ধকার হচ্ছে।

লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত মুসলমানরা অতল গহ্বরে পড়ছে না, বরং এটি পশ্চিমা আলোচনা, যা নৈতিক পরীক্ষায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। সাদিক খান এবং জোহরান মামদানির মধ্যে শহরগুলো নয়, বরং তাদের কাছে থাকা আয়নাগুলোই পরিবর্তিত হচ্ছে।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তরিত

কারাম নামা : ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম