শূন্যতার প্রাকৃতিক নিয়ম ও বাংলাদেশের সমাজ পাঠ 
jugantor
শূন্যতার প্রাকৃতিক নিয়ম ও বাংলাদেশের সমাজ পাঠ 

  মুহাম্মদ মহিউদ্দীন   

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৪০:৫৭  |  অনলাইন সংস্করণ

শূন্যতার প্রাকৃতিক নিয়ম (দ্য ন্যাচারাল ল অব ভ্যাকুয়াম) অনুযায়ী প্রকৃতি শূন্য স্থান পছন্দ করে না। আপনি যদি পূরণ না করেন, তা হলে প্রকৃতি নিজেই সেটি পূরণ করে নেবে। কথাগুলো বলেছিলেন আমেরিকান লেখক ও উদ্যোক্তা স্টিভেন অ্যানডার্সন যিনি অনেক বই লিখেছেন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, যার কয়েকটি হলো— দ্য বাইসাইকেল বুক, দ্য কালচার অব সাকসেস এবং দ্য থার্টিন বিগেস্ট মিস্টেকস অব পেরেন্টস মেক ইত্যাদি।

যে কথা বলার জন্য এতগুলো বইয়ের কথা বললাম, তার মূল কারণ হলো— আমরা কি আমাদের সমাজে কোনো শূন্য স্থান দেখতে পাই?

আদর্শে, শিক্ষায়, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে? সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে ভ্রেডেফোর্ট গ্রহাণু আঘাতের পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি শূন্যতা আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে। তবে সমাজের এই শূন্যতা দারুণ ব্যাখ্যা করেছে সমাজবিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব। যেমন স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম।

এরা মনে করে সমাজে যখন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, অথবা যে উপাদানগুলো সমাজকাঠামো তৈরি করে তা যদি ভেঙে পড়ে তা হলে শূন্যতা তৈরি হবে। এটিকে আরও ভালোভাবে দেখা যাবে সমাজবিজ্ঞানের আরেকটি তত্ত্ব দিয়ে, যার নাম ‘সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব’ বা সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ থিওরি।

এ তত্ত্ব মনে করে শূন্যতা তৈরি হয় মূলত ব্যক্তির অপূর্ণ বা অতৃপ্ত সামাজিক বিনিময় থেকে। যে কোনো মানুষ শূন্যতা অনুভব করতে পারে যদি সে তার প্রাপ্য বা প্রত্যাশিত পুরস্কার বা স্বীকৃতি না পায়। আমার দৃষ্টিতে দুটি অবস্থাই আমাদের সমাজে বিদ্যমান। প্রথমে আলোকপাত করা যাক— স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম তত্ত্বের দিকে। তা হলে আমাদের সমাজে কীভাবে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে? সব কিছুর একটা নির্মাণ আছে।

ঠিক একইভাবে আমাদের সমাজেরও নির্মাণ আছে যাকে আমরা সমাজকাঠামো বলি। এই সমাজকাঠামোর কিছু অবিচ্ছেদ্য উপাদান আছে যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আজকের সমাজের শূন্যতা যাচাই করতে পারি। যেমন— এক. প্রত্যেকটি সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি, দুই. সামাজিক প্রতিষ্ঠানঃ পরিবার, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন ইত্যাদি। তিন. সামাজিক শ্রেণিঃ যারা নিজেদের শিক্ষা, আয় ও পেশা দিয়ে একটি সাধারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করে। চার. সামাজিক ভূমিকাঃ সমাজে মানুষের কাছ থেকে তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার ও কাজকর্ম। পাঁচ. সামাজিক নিয়মঃ সমাজের অলিখিত নিয়ম যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া আরও কিছু উপাদান আছে, তবে এগুলোকে মুখ্য ধরে এগোতে পারি। প্রথমে আলোচনা করা যাক— আমাদের সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে।

আমাদের সমাজের সংস্কৃতি সবসময় ছিল সঙ্কর বা মিক্সড। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। ১৯৯০ দশকের দিকে আমাদের যখন শৈশব তখন দেখতাম আউশ ধান উঠে গেলে গ্রামে গ্রামে মেলা হতো। শীতের রাতে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক গানের আসর, পুঁথির আসর বসত। মানুষের উঠোনে নানা (কাল্পনিক) গল্পের আসর হতো।

এই গল্প শুনতে শুনতে মায়ের কোলে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত। মাঝে মাঝে স্বপ্নে সেসব গল্পের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে দেখাও হতো। স্কুল-কলেজে নানা উৎসব ও মেলা হতো। আমার গ্রামে একটা মাধ্যমিক স্কুল আছে নাম বিবি চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। ডিসেম্বর মাস উপলক্ষ্যে সেখানে মাসব্যাপী মেলা, নাটক, গান, কবিতা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি প্রথম ওই স্কুলের মঞ্চ নাটক থেকে শুনেছি । শুধু আমাদের গ্রামে না, সব স্কুলেই এ ধরনের অনুষ্ঠান হতো। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিশুরা নানাবিধ জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতো। মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করত এই স্কুলগুলো। এখনো আউশ ধান উঠে, শীত আসে। কিন্তু সেই আসরগুলো আর বসে না। এই শূন্যস্থানটা দখল করেছে এককশ্রেণির ধর্মীয় বক্তা। যারা ধর্ম প্রচারের চেয়ে নিজের মতবাদ প্রচার, অন্য মতবাদের সমালোচনা, ও আত্মপ্রচারে বেশি মগ্ন থাকে, যা সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে সবাই এমন নয়।

অনেক বক্তা সঠিক ধর্ম প্রচার করেন। কিন্তু এমন অনেক বক্তা আছেন, যারা উগ্রপন্থার প্রচারও করেন এসব অনুষ্ঠানে। এমনকি অনেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছেন। মজার বিষয় হলো— এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে সাধারণ মানুষ এবং বক্তারা নেন বিশাল অঙ্কের ফি। অনেকে আবার বিলাসবহুল গাড়িতে হাজির হন। অনেকে আবার হেলিকপ্টারও ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে একশ্রেণির বক্তার পকেট ভরছে। আর সমাজ একমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিমজ্জিত হচ্ছে। এভাবে সমাজে এক বিশাল সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যার সুযোগ এসব বক্তা নিচ্ছে।

দুই

সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও অনেক বিবর্তন হয়েছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন অর্থ ও ক্ষমতার ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়েছে। এমন নয় যে আগে অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাব ছিল না। আগে যেসব মানুষের হাতে টাকা ও ক্ষমতা থাকত, সেসব মানুষের থাকত প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক শিক্ষা। কাজেই অর্থ ও ক্ষমতা কখনো শিক্ষা ও পারিবারিক পরিচিতিকে অতিক্রম করে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘নৈতিকতা’ ও ‘সামাজিক লজ্জা’ কাজ করত, যা তাকে অনেক কাজ থেকে বিরত রাখত। কিন্তু এখন সমাজের আবরণ পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ ও ক্ষমতা ক্রমশ শিক্ষা ও পরিবার থেকে বের হয়ে গেছে। এখন অর্থ ও ক্ষমতা থাকলেই সমাজে আধিপত্য তৈরি করা যায়। এক কথায়— অর্থ ও ক্ষমতাই এখন সমাজে প্রতিপত্তির মূল কারণ।

তিন

সামাজিক শ্রেণি তৈরি হয় মানুষের পেশা, শিক্ষা ও আয় ওপর ভিত্তি করে, যার মাধ্যমে মানুষ সমাজে তার আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলে। কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখবেন, আজকাল সমাজে আয়ের জন্য শিক্ষা বা পেশা কোনোটারই দরকার নেই। কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না এই টাকা আপনি কোথা থেকে কীভাবে আয় করলেন। এমনকি আপনার টাকা কোন পথে আয় করলেন তাও জিজ্ঞেস করবে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই টাকা দান করে দানবীর, সমাজসেবক, জনদরদী ইত্যাদি হয়ে যেতে পারেন। সমাজকাঠামোতে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গণ্য না করলেও বর্তমান সমাজে এটিই এখন সব চেয়ে বড় পেশা। শূন্য বিনিয়োগে পূর্ণতা পাওয়ার সহজ উপায়। কাজেই শিক্ষা ও পেশা মানুষের আয় নির্ধারণ না করায় সমাজে পেশাহীন অর্থ অনর্থ তৈরি করছে। সমাজে এখন অর্থ ও রাজনীতির প্রভার প্রকট। সুতরাং আগামী প্রজন্ম যে কোনো উপায়ে টাকা আর ক্ষমতা পেতে চাইবে। কারণ এখন বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠানে যাদেরকে প্রধান মেহমান করা হয়। এরা হয় অর্থবান নয়তো ক্ষমতাবান। সেখানে উপস্থিত সাধারণ মানুষ ও শিশুরা নিজের অজান্তেই ওদের মতো হতে চাইবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফলে সমাজে এক ধরনের মেধাহীন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যার সুযোগ নিচ্ছে এই বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানরা।

চার

সামাজিক ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল শিক্ষা, পেশা ও জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। যে সমাজ যতবেশি শিক্ষিত ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ, সে সমাজে মানুষের ভূমিকাও হবে ততটা সমৃদ্ধ। আমাদের সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। তাই আমাদের সমাজে মানুষের আচরণ ও কাজকর্মও ব্যতিক্রম। যে সমাজ অর্থের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, সে সমাজের কাঠামো হবে অনিয়ন্ত্রিত, দুর্নীতিগ্রস্ত ও সারহীন। এই সমাজ থেকে ভালো প্রজন্ম তৈরি করা কঠিন ও অবাস্তব। সমাজের এই শূন্যতা থেকে তৈরি হয় অনিয়ম, দুর্নীতি, টাকা পাচার, হত্যা, রাহাজানি, নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য অপরাধ। পাঁচ. সমাজে একটা অলিখিত নিয়ম আছে, যা মানবিক মূল্যবোধের ওপর টিকে থাকে। এই নিয়ম বা আইন সংসদে পাশ হয় না। সমাজের মানুষেরাই নির্ধারণ করে থাকে। এই নিয়ম কিছুটা ধর্ম, দর্শন ও জীবনবোধ থেকে তৈরি হয়েছে। যেমন— মুসলিম সমাজে কোনো মুরব্বি দেখলে সাধারণত আমরা সালাম দিই। এটা ধর্ম থেকে এসেছে। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় খালি কলসি রাখতে হয় না, এটিও সম্ভবত হিন্দু ও গ্রামীণ সমাজের প্রাচীন চর্চা। মুরব্বিদের সামনে উঁচুস্বরে কথা বলা ঠিক না এটিও একটি সমাজের অলিখিত নিয়ম। এসব নিয়ম তৈরি হয় মানুষের শিক্ষা, পরিবার ও পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া থেকে। সুতরাং সমাজে মানুষের আচরণ পরিবর্তন হলে, সমাজের নিয়মও পরিবর্তন হয়ে যাবে। বর্তমানে আমাদের সমাজে অনেক অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। যেমন— ঢাকা শহরে কোনো অফিসের পিয়ন আটতলা বাড়ি করলে, মানুষ এটিকে এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিচ্ছে। অনেকে টাকা পাচার করলেও মানুষ খুব বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। কারণ এটিই হচ্ছে সমাজে। কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে, সে সঠিক বিচার নাও পেতে পারে এ ধারণাও মানুষের মনে তৈরি হয়েছে। আরও কতশত উদাহরণ আছে যা অনিয়ম অথচ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তা হলে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, আমাদের সমাজে একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে মূলত সমাজকাঠামোর উপাদানগুলোতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার কারণে অথবা সমাজকাঠামোর উপাদানগুলো ভেঙে পড়ার কারণে। আমাজের সমাজে কিছু কিছু উপাদান বিলুপ্ত হয়ে গেছে যেমন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। শুধু ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখে বাংলাদেশের ৬৭ হাজার গ্রামকে বিবেচনা করলে হবে না। ঢাকার সাংস্কৃতিক চর্চাকে এলিট সংস্কৃতি বলাই ভালো। কারণ এটি সমগ্র বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না আবার গ্রামের মানুষ এগুলো বুঝতেও পারে না। এর পরে আসা যাক সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের দিকে। আমাদের সমাজে সবাই একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বা সবাই রসাতলে গেছে এমন নয়। অনেক মানুষ বা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রতিনিয়ত সমাজের কল্যাণে কাজ করে যান। কোভিড-১৯ এর কঠিন সময়ে আমরা দেখেছি অনেকে তাদের জীবনবাজি রেখে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া প্রান্তিক মানুষের সাহায্য করেন। গত বছর সিলেটে বন্যার সময় অনেক সাধারণ যুবক সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে ফান্ড সংগ্রহ করেছেন বন্যার্তদের জন্য। অনেক যুবক গ্রামে গ্রামে বই বিতরণ করে বেড়াচ্ছেন। অনেকে চাঁদা তুলে গরিব মানুষকে সাহায্য করছেন। অনেকে স্নাতক পাশ করে গ্রামে খামার গড়ে তুলছেন। কৃষিকাজ করছেন। অনেকে সামান্য পুঁজি নিয়ে সামজিক ব্যবসা গড়ে তুলছেন।

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। কিন্তু তাদের এ কর্মের স্বীকৃতি কী? সমাজে সব ধরনের স্বীকৃতি বা পুরস্কার তো চলে যায় ক্ষমতাবান বা অর্থবানদের কাছে। যারা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পুরস্কার কই? তাদের কীভাবে জাতি মূল্যায়ন করে? তাদের সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটুকু উৎসাহিত করে? এরাই তো সমাজের প্রকৃত নায়ক বা আদর্শ। কিন্তু সমাজে এরা নিগৃহীত। বঞ্চিত। পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও শূন্যতা অনুভূত হয়। সমাজ তাদেরকে যথাযত মূল্যায়ন না করার কারণে বা তাদের প্রত্যাশিত পুরস্কার না দেওয়ার কারণে তাদের মধ্যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, যা তাকে পরবর্তী পদক্ষেপ বা ভূমিকা পালন থেকে বিরত রাখতে পারে। দ্যা ন্যাচারাল ল অব ভ্যাকুয়াম, স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম ও সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব মতে সমাজে শূন্যতা তৈরি হলে কেউ না কেউ প্রাকৃতিকভাবে এ স্থান দখল করে নেবে। যার উদাহরণ সমাজে অর্থ ও ক্ষমতার অসীম আধিপত্য ও হালের নায়ক হিরো আলম। সমাজে অনুকরণযোগ্য নায়ক না থাকলে মানুষ যে কাউকে নায়ক বানিয়ে নেবে। শূন্য স্থান কখনো শূন্য থাকে না।

লেখকঃ ভিজিটিং স্কলার, মিনিসোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র, পিএইচডি গবেষক, ফেরারা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি ও সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শূন্যতার প্রাকৃতিক নিয়ম ও বাংলাদেশের সমাজ পাঠ 

 মুহাম্মদ মহিউদ্দীন  
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:৪০ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

শূন্যতার প্রাকৃতিক নিয়ম (দ্য ন্যাচারাল ল অব ভ্যাকুয়াম) অনুযায়ী প্রকৃতি শূন্য স্থান পছন্দ করে না। আপনি যদি পূরণ না করেন, তা হলে প্রকৃতি নিজেই সেটি পূরণ করে নেবে। কথাগুলো বলেছিলেন আমেরিকান লেখক ও উদ্যোক্তা স্টিভেন অ্যানডার্সন যিনি অনেক বই লিখেছেন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, যার কয়েকটি হলো— দ্য বাইসাইকেল বুক, দ্য কালচার অব সাকসেস এবং দ্য থার্টিন বিগেস্ট মিস্টেকস অব পেরেন্টস মেক ইত্যাদি। 

যে কথা বলার জন্য এতগুলো বইয়ের কথা বললাম, তার মূল কারণ হলো— আমরা কি আমাদের সমাজে কোনো শূন্য স্থান দেখতে পাই? 

আদর্শে, শিক্ষায়, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে? সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে ভ্রেডেফোর্ট গ্রহাণু আঘাতের পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি শূন্যতা আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে। তবে সমাজের এই শূন্যতা দারুণ ব্যাখ্যা করেছে সমাজবিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব। যেমন স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম। 

এরা মনে করে সমাজে যখন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, অথবা যে উপাদানগুলো সমাজকাঠামো তৈরি করে তা যদি ভেঙে পড়ে তা হলে শূন্যতা তৈরি হবে। এটিকে আরও ভালোভাবে দেখা যাবে সমাজবিজ্ঞানের আরেকটি তত্ত্ব দিয়ে, যার নাম ‘সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব’ বা সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ থিওরি। 

এ তত্ত্ব মনে করে শূন্যতা তৈরি হয় মূলত ব্যক্তির অপূর্ণ বা অতৃপ্ত সামাজিক বিনিময় থেকে। যে কোনো মানুষ শূন্যতা অনুভব করতে পারে যদি সে তার প্রাপ্য বা প্রত্যাশিত পুরস্কার বা স্বীকৃতি না পায়। আমার দৃষ্টিতে দুটি অবস্থাই আমাদের সমাজে বিদ্যমান। প্রথমে আলোকপাত করা যাক— স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম তত্ত্বের দিকে। তা হলে আমাদের সমাজে কীভাবে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে? সব কিছুর একটা নির্মাণ আছে। 

ঠিক একইভাবে আমাদের সমাজেরও নির্মাণ আছে যাকে আমরা সমাজকাঠামো বলি। এই সমাজকাঠামোর কিছু অবিচ্ছেদ্য উপাদান আছে যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আজকের সমাজের শূন্যতা যাচাই করতে পারি। যেমন— এক. প্রত্যেকটি সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি, দুই. সামাজিক প্রতিষ্ঠানঃ  পরিবার, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন ইত্যাদি। তিন. সামাজিক শ্রেণিঃ যারা নিজেদের শিক্ষা, আয় ও পেশা দিয়ে একটি সাধারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করে। চার. সামাজিক ভূমিকাঃ সমাজে মানুষের কাছ থেকে তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার ও কাজকর্ম। পাঁচ. সামাজিক নিয়মঃ সমাজের অলিখিত নিয়ম যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া আরও কিছু উপাদান আছে, তবে এগুলোকে মুখ্য ধরে এগোতে পারি। প্রথমে আলোচনা করা যাক— আমাদের সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে। 

আমাদের সমাজের সংস্কৃতি সবসময় ছিল সঙ্কর বা মিক্সড। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। ১৯৯০ দশকের দিকে আমাদের যখন শৈশব তখন দেখতাম আউশ ধান উঠে গেলে গ্রামে গ্রামে মেলা হতো। শীতের রাতে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক গানের আসর, পুঁথির আসর বসত। মানুষের উঠোনে নানা (কাল্পনিক) গল্পের আসর হতো। 

এই গল্প শুনতে শুনতে মায়ের কোলে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত। মাঝে মাঝে স্বপ্নে সেসব গল্পের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে দেখাও হতো। স্কুল-কলেজে নানা উৎসব ও মেলা হতো। আমার গ্রামে একটা মাধ্যমিক স্কুল আছে নাম বিবি চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। ডিসেম্বর মাস উপলক্ষ্যে সেখানে মাসব্যাপী মেলা, নাটক, গান, কবিতা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো। 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি প্রথম ওই স্কুলের মঞ্চ নাটক থেকে শুনেছি । শুধু আমাদের গ্রামে না, সব স্কুলেই এ ধরনের অনুষ্ঠান হতো। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিশুরা নানাবিধ জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতো। মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করত এই স্কুলগুলো। এখনো আউশ ধান উঠে, শীত আসে। কিন্তু সেই আসরগুলো আর বসে না। এই শূন্যস্থানটা দখল করেছে এককশ্রেণির ধর্মীয় বক্তা। যারা ধর্ম প্রচারের চেয়ে নিজের মতবাদ প্রচার, অন্য মতবাদের সমালোচনা, ও আত্মপ্রচারে বেশি মগ্ন থাকে, যা সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে সবাই এমন নয়। 

অনেক বক্তা সঠিক ধর্ম প্রচার করেন। কিন্তু এমন অনেক বক্তা আছেন, যারা উগ্রপন্থার প্রচারও করেন এসব অনুষ্ঠানে। এমনকি অনেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছেন। মজার বিষয় হলো— এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে সাধারণ মানুষ এবং বক্তারা নেন বিশাল অঙ্কের ফি। অনেকে আবার বিলাসবহুল গাড়িতে হাজির হন। অনেকে আবার হেলিকপ্টারও ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে একশ্রেণির বক্তার পকেট ভরছে। আর সমাজ একমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিমজ্জিত হচ্ছে। এভাবে সমাজে এক বিশাল সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যার সুযোগ এসব বক্তা নিচ্ছে। 

দুই

সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও অনেক বিবর্তন হয়েছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন অর্থ ও ক্ষমতার ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়েছে। এমন নয় যে আগে অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাব ছিল না। আগে যেসব মানুষের হাতে টাকা ও ক্ষমতা থাকত, সেসব মানুষের থাকত প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক শিক্ষা। কাজেই অর্থ ও ক্ষমতা কখনো শিক্ষা ও পারিবারিক পরিচিতিকে অতিক্রম করে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘নৈতিকতা’ ও ‘সামাজিক লজ্জা’ কাজ করত, যা তাকে অনেক কাজ থেকে বিরত রাখত। কিন্তু এখন সমাজের আবরণ পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ ও ক্ষমতা ক্রমশ শিক্ষা ও পরিবার থেকে বের হয়ে গেছে। এখন অর্থ ও ক্ষমতা থাকলেই সমাজে আধিপত্য তৈরি করা যায়। এক কথায়— অর্থ ও ক্ষমতাই এখন সমাজে প্রতিপত্তির মূল কারণ। 

তিন 

সামাজিক শ্রেণি তৈরি হয় মানুষের পেশা, শিক্ষা ও আয় ওপর ভিত্তি করে, যার মাধ্যমে মানুষ সমাজে তার আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলে। কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখবেন, আজকাল সমাজে আয়ের জন্য শিক্ষা বা পেশা কোনোটারই দরকার নেই। কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না এই টাকা আপনি কোথা থেকে কীভাবে আয় করলেন। এমনকি আপনার টাকা কোন পথে আয় করলেন তাও জিজ্ঞেস করবে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই টাকা দান করে দানবীর, সমাজসেবক, জনদরদী ইত্যাদি হয়ে যেতে পারেন। সমাজকাঠামোতে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গণ্য না করলেও বর্তমান সমাজে এটিই এখন সব চেয়ে বড় পেশা। শূন্য বিনিয়োগে পূর্ণতা পাওয়ার সহজ উপায়। কাজেই শিক্ষা ও পেশা মানুষের আয় নির্ধারণ না করায় সমাজে পেশাহীন অর্থ অনর্থ তৈরি করছে। সমাজে এখন অর্থ ও রাজনীতির প্রভার প্রকট। সুতরাং আগামী প্রজন্ম যে কোনো উপায়ে টাকা আর ক্ষমতা পেতে চাইবে। কারণ এখন বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠানে যাদেরকে প্রধান মেহমান করা হয়। এরা হয় অর্থবান নয়তো ক্ষমতাবান। সেখানে উপস্থিত সাধারণ মানুষ ও শিশুরা নিজের অজান্তেই ওদের মতো হতে চাইবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফলে সমাজে এক ধরনের মেধাহীন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যার সুযোগ নিচ্ছে এই বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানরা।   

চার 

সামাজিক ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল শিক্ষা, পেশা ও জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। যে সমাজ যতবেশি শিক্ষিত ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ, সে সমাজে মানুষের ভূমিকাও হবে ততটা সমৃদ্ধ। আমাদের সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। তাই আমাদের সমাজে মানুষের আচরণ ও কাজকর্মও ব্যতিক্রম। যে সমাজ অর্থের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, সে সমাজের কাঠামো হবে অনিয়ন্ত্রিত, দুর্নীতিগ্রস্ত ও সারহীন। এই সমাজ থেকে ভালো প্রজন্ম তৈরি করা কঠিন ও অবাস্তব। সমাজের এই শূন্যতা থেকে তৈরি হয় অনিয়ম, দুর্নীতি, টাকা পাচার, হত্যা, রাহাজানি, নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য অপরাধ। পাঁচ. সমাজে একটা অলিখিত নিয়ম আছে, যা মানবিক মূল্যবোধের ওপর টিকে থাকে। এই নিয়ম বা আইন সংসদে পাশ হয় না। সমাজের মানুষেরাই নির্ধারণ করে থাকে। এই নিয়ম কিছুটা ধর্ম, দর্শন ও জীবনবোধ থেকে তৈরি হয়েছে। যেমন— মুসলিম সমাজে কোনো মুরব্বি দেখলে সাধারণত আমরা সালাম দিই। এটা ধর্ম থেকে এসেছে। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় খালি কলসি রাখতে হয় না, এটিও সম্ভবত হিন্দু ও গ্রামীণ সমাজের প্রাচীন চর্চা। মুরব্বিদের সামনে উঁচুস্বরে কথা বলা ঠিক না এটিও একটি সমাজের অলিখিত নিয়ম। এসব নিয়ম তৈরি হয় মানুষের শিক্ষা, পরিবার ও পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া থেকে। সুতরাং সমাজে মানুষের আচরণ পরিবর্তন হলে, সমাজের নিয়মও পরিবর্তন হয়ে যাবে। বর্তমানে আমাদের সমাজে অনেক অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। যেমন— ঢাকা শহরে কোনো অফিসের পিয়ন আটতলা বাড়ি করলে, মানুষ এটিকে এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিচ্ছে। অনেকে টাকা পাচার করলেও মানুষ খুব বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। কারণ এটিই হচ্ছে সমাজে। কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে, সে সঠিক বিচার নাও পেতে পারে এ ধারণাও মানুষের মনে তৈরি হয়েছে। আরও কতশত উদাহরণ আছে যা অনিয়ম অথচ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তা হলে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, আমাদের সমাজে একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে মূলত সমাজকাঠামোর উপাদানগুলোতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার কারণে অথবা সমাজকাঠামোর উপাদানগুলো ভেঙে পড়ার কারণে। আমাজের সমাজে কিছু কিছু উপাদান বিলুপ্ত হয়ে গেছে যেমন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। শুধু ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখে বাংলাদেশের ৬৭ হাজার গ্রামকে বিবেচনা করলে হবে না। ঢাকার সাংস্কৃতিক চর্চাকে এলিট সংস্কৃতি বলাই ভালো। কারণ এটি সমগ্র বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না আবার গ্রামের মানুষ এগুলো বুঝতেও পারে না। এর পরে আসা যাক সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের দিকে। আমাদের সমাজে সবাই একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বা সবাই রসাতলে গেছে এমন নয়। অনেক মানুষ বা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রতিনিয়ত সমাজের কল্যাণে কাজ করে যান। কোভিড-১৯ এর কঠিন সময়ে আমরা দেখেছি অনেকে তাদের জীবনবাজি রেখে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া প্রান্তিক মানুষের সাহায্য করেন। গত বছর সিলেটে বন্যার সময় অনেক সাধারণ যুবক সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে ফান্ড সংগ্রহ করেছেন বন্যার্তদের জন্য।  অনেক যুবক গ্রামে গ্রামে বই বিতরণ করে বেড়াচ্ছেন। অনেকে চাঁদা তুলে গরিব মানুষকে সাহায্য করছেন। অনেকে স্নাতক পাশ করে গ্রামে খামার গড়ে তুলছেন। কৃষিকাজ করছেন। অনেকে সামান্য পুঁজি নিয়ে সামজিক ব্যবসা গড়ে তুলছেন। 

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। কিন্তু তাদের এ কর্মের স্বীকৃতি কী? সমাজে সব ধরনের স্বীকৃতি বা পুরস্কার তো চলে যায় ক্ষমতাবান বা অর্থবানদের কাছে। যারা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পুরস্কার কই? তাদের কীভাবে জাতি মূল্যায়ন করে? তাদের সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটুকু উৎসাহিত করে? এরাই তো সমাজের প্রকৃত নায়ক বা আদর্শ। কিন্তু সমাজে এরা নিগৃহীত। বঞ্চিত। পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও শূন্যতা অনুভূত হয়। সমাজ তাদেরকে যথাযত মূল্যায়ন না করার কারণে বা তাদের প্রত্যাশিত পুরস্কার না দেওয়ার কারণে তাদের মধ্যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, যা তাকে পরবর্তী পদক্ষেপ বা ভূমিকা পালন থেকে বিরত রাখতে পারে। দ্যা ন্যাচারাল ল অব ভ্যাকুয়াম, স্ট্রাকচারাল ফাংশানালিজম ও সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব মতে সমাজে শূন্যতা তৈরি হলে কেউ না কেউ প্রাকৃতিকভাবে এ স্থান দখল করে নেবে। যার উদাহরণ সমাজে অর্থ ও ক্ষমতার অসীম আধিপত্য ও হালের নায়ক হিরো আলম। সমাজে অনুকরণযোগ্য নায়ক না থাকলে মানুষ যে কাউকে নায়ক বানিয়ে নেবে। শূন্য স্থান কখনো শূন্য থাকে না।  

লেখকঃ ভিজিটিং স্কলার, মিনিসোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র, পিএইচডি গবেষক, ফেরারা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি ও সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন