মন ভালো নেই

 শেলীনা আফরোজা 
২৯ মে ২০২৩, ১০:৫১ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ
মন
প্রতীকী ছবি

সময় চলে যায় চোখের পলকে। গত বছর ২০ জুন আমাদের মেনে নিতে হয়েছিল চরম বাস্তবতাকে। শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন আহমেদ স্যার এপারের ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে যাত্রা করেন পরলোকের বৃহত্তর পরিসরে। স্যার যখন হাসপাতালে আমি দেখতে যাই এবং বেশ কিছুটা সময় কাটাই। তিনি কোনোদিন কোনো কিছুতেই হার মানেননি। সেদিনও তেমনি। হাজার প্রসঙ্গ তোলেন, খুব ভালোলাগা কাটানো সময়কে পুঁজি করে ঘরে ফিরি। তারপর আর দেখা মেলেনি। ঘরে ফিরে স্যারকে না বলা কথা গুলো নিয়ে একটা চিঠি লিখি। সেটি স্যারকে দেখাবো ইচ্ছা ছিল, ইচ্ছা পূরণ হয়নি। স্যারের চলে যাওয়ার একবছর পূর্ণ হলো, ভাবছি চিঠিটা প্রকাশ করবো। যদি স্যার দূর থেকে দেখতে পান, অনুভব করেন- সেই প্রত্যাশায়। 

শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন স্যার,

১২ জুন রোববার ২০২২, পিজি হাসপাতালে আপনাকে দেখতে যেতে চাইলাম, আপনার ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘ভাই খুব ক্লান্ত আজ না আসলেই ভালো’। এমন দিন দেখতে হবে কখনো কল্পনাও করিনি।  দেশ স্বাধীন হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ চলছে, ইউরোপের তৎকালীন বাংলাদেশ দূতবাস সমূহের বাঙালি কূটনীতিকরা যখন চুপচাপ, তেমনি সময়ে আপনিই সেই প্রথম বাঙালি কূটনিতীবিদ, যিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিবের পদ ছেড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে বিদেশের মাটিতে বুক ফুলিয়ে জয়বাংলা বলার সাহস করেছিলেন, সেই সাহসী তরুণ কেন হার মানবে। দেশের সেই কঠিন সময়ে আপনি আবু সাঁইদ চৌধুরীর সঙ্গে লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সার্বক্ষণিক দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন, আপনি কেনো চুপ করে থাকবেন। আমার মন সাঁই দিচ্ছে না। হার মেনে নেয়া আপনাকে মানায় না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আপনি, আপনি স্বনামধন্য কলামিস্ট, মানুষের ভালো দিক খুঁজে বের করে তা সবাইকে জানাতে পেরে সুখী হন। কারো বড়ধরনের ভুল ধরিয়ে দিতে কখনো দ্বিধা করেননি। সাহসী আপনি, সততার প্রতীক আপনি। কেনোই বা হবেন না, নূরপুরের অহংকার প্রধান শিক্ষক আবদুর রশীদ মাস্টারের রক্ত বইছে আপনার শরীরে, কিসের ভয় আপনার। জি এম হাটের মানুষ দেশে এবং বিদেশে যে যেখানে আছেন, আপনার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করছেন। আপনার প্রিয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সব বয়সের সবাই আপনার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন। সাংবাদিক মহলে আপনি সবার শ্রদ্ধাভাজন। আপনার কাছ থেকে শেখা আমাদের শেষ হয়নি। যে ভয় আপনার কাছে আসতে ভয় পেয়েছে তাকে আমরা পরোয়া করি না। 

বঙ্গভবনের মাঠে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উদযাপন হবে আর সেখানে আপনি নেই, তা কখনই হয়নি, হতে পারে না। লিমিটেড এডিশনের আপনার লাল সবুজ টাইয়ের গল্প শুনেছি প্রতিটি অনুষ্ঠানে, তাতেও আমার সাধ মেটেনি, আবারো শুনতে চাই সে গল্প, বিজয় দিবস তো খুব বেশি দূরে নয়। 

আপনি যখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবাইকে পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, গাজীপুরের তূলা উন্নয়ন করপোরেশনের বাংলোয়, এবারে আমাদের পালা আপনাকে নিয়ে দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যাওয়ার। দেখা হলেই বলেন, মৎস্য সচিব আমাকে ইলিশ মাছ খাওয়ায় নাই, বলেই প্রাণ খোলা হাসি হেসে সবাইকে আনন্দ দিয়েছেন। ফেস বুকে না দেখলেই বলবেন, তোমার বনমালির ফুলের ছবি দেখিনা অনেকদিন। কখনো ছোট্ট কিছু পাঠালেও ফোন করে বাড়িয়ে বলেছেন অনেক কথা। মানুষের মন জয় করার অসাধারণ ক্ষমতা আপনের। আপনাকে ছাড়া আমরা শূন্য। 

আপনি তো জানেন দেহের শক্তির চেয়ে মনোবল বেশি শক্তিশালী। কতটা ভালোবাসলে আপনার মেয়ে অরু সব কাজ ফেলে লন্ডন থেকে ঢাকায় চলে আসতে পারে। ভাবির সেবা আপনাকে করেছে সুখী এবং যারপরনাই সাহসী। ১২ বছর আগে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ শুরু করেছেন, সেও পরাহত। অসত্য এবং অসুন্দরকে হার মানিয়েছেন, সেই ১৯৭১ থেকে সব ক্ষেত্রেই আপনার সাহস আর মনোবলের জয় হয়েছে।

গত ৩১ মে, ২০২২, যখন আপনি পিজি হাসপাতালের ৫২০ নম্বর কেবিনে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, আমি না জানিয়েই গিয়ে হাজির। বিরক্ত হননি বরং আপনার হৃদয় ছোয়া হাসি দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়েছে। দুজন মেয়ে এলো আপনাকে দেখতে, আমি যা নই তাই বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে হাজারো প্রশ্ন করলেন। আমার মায়ের প্রতি আপনার অগাধ শ্রদ্ধার কথা জানালেন, এক পর্যায়ে বললেন তোমার ছেলে আর ওর বৌ কত ভালো করেছে ওদের কথা বলো। নিরুপায় হয়ে বলতে হলো। যদিও সময়টা অনুকূল ছিল না। বললাম আপনার ছবি না তুলে আমি যাব না। আপনার শিশু সুলভ হাসি ধারণ করল আমার মুঠোফোন। 

আপনার হাত দুটি ধরে বলতে চাই, ‘আপনি কি, তা আপনি নিজেও জানেন না’। আর আপনাকে আমি এবং আপনার পরিচিত সবাই কত ভালোবাসি তা আমরা নিজেরাও জানি না। এ সুযোগ থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না। 
শিউলিতলা আপনার প্রতীক্ষায় আছে। 
লেখক: সাবেক সচিব

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন