বসবাসের অযোগ্য থেকে স্মার্ট ও বাসযোগ্য রাজধানী ঢাকা সম্ভব
প্রাণের শহর রাজধানী ঢাকা দিনকে দিন নগরবাসীর কাছে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। বায়ুদূষণ, পানি, শব্দ ও আলোদূষণের পাশাপাশি যানজটে স্থবির জনজীবন। তার ওপর ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি মানুষের চাপে পিষ্ট ‘জাদুর শহর’। কীভাবে এ নগরী আবারও প্রাণ জুড়ানো শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার উপযোগী এবং স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলা যায়— সেটিই বর্তমান সময়ে সর্বমহলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়।
একটি স্মার্ট সিটির লক্ষ্য হলো— প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করা, অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং আরও টেকসই এবং দক্ষ শহুরে পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এমন একটি শহর গড়ে তোলা যা প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখবে। প্রকৃতির সব রূপ গ্রহণ করে এমন একটা সবুজ অবকাঠামো তৈরি করা যাতে শহরের বাসিন্দারা তা উপভোগ করতে পারে। স্মার্ট সিটিতে যা থাকা প্রয়োজন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই প্রয়োজন স্মার্ট পরিবহণ ব্যবস্থা, যা যানজট কমাতে সাহায্য করবে। তার পর প্রয়োজন, স্মার্ট এনার্জি সিস্টেম যা শক্তির অপচয় এবং কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করবে রিয়েল-টাইম ডেটা ব্যবহার করে।
অন্যদিকে স্মার্ট ঢাকা গড়তে স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের গুরুত্ব অপরিসীম, যেখানে নগরীর বর্জ্য সংগ্রহকে অপটিমাইজ করতে এবং আবর্জনা কমাতে সেন্সর ব্যবহার করতে হবে। নগরীতে প্রয়োজন স্মার্ট পাবলিক সেফটি সিস্টেম যা অপরাধের হার কমাতে সাহায্য করবে ডেটা এবং বিশ্লেষণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সর্বপরি, একটি স্মার্ট নগরীতে প্রয়োজন স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যা পানির ব্যবহার নিরীক্ষণ ও পরিচালনা এবং বর্জ্য কমাতে সহায়তা করবে। তাই সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশে বিনির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই জনমনে একটি প্রশ্ন— আদৌ কি সম্ভব ঢাকাকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করা?
তাই নানা বাধাবিপত্তি আর চ্যালেঞ্জ জয় করেই ঢাকাসহ সারা দেশের টেকসই উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। লক্ষ্য— ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল থেকে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই গড়তে হবে স্মার্ট ঢাকা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ কার্যক্রম আবর্তিত হয় এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই। তাই ঢাকা যত দ্রুত স্মার্ট হবে, তত দ্রুতই স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্মার্ট সিটির মূল স্তম্ভগুলো নিয়ে কার্যকরভাবে ঢাকা শহরের জন্য অতিদ্রুত কাজ করতে হবে। স্মার্ট গভর্ন্যান্স, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট মোবিলিটি, স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, স্মার্ট পিপল এবং স্মার্ট লিভিং— এগুলোই স্মার্ট সিটির মূল স্তম্ভ। আর নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী বিষয় আনতে হবে, যাতে মানুষের জীবনযাত্রা আরও সহজ হয়।
গত ৬০-৭০ বছরে তিলোত্তমা নগরী রাজধানী ঢাকার জন্য যেসব পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা, উদ্যোগ, আয়োজন করা হয়েছে, সেগুলোও একেবারে কম নয়। কিন্তু তাতে ঢাকা কি বাসযোগ্য নগরী হয়ে উঠেছে? রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। সেই তুলনায় দেখা যায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে।
ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে প্রায় ৪০০-৫০০ জন। অন্যদিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়। রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করেন ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ। এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ শতাংশ সঠিক ছিল। তবে ৩০ শতাংশ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এর পর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
মোর্দাকথা হলো— রাজধানী ঢাকাকে নাগরিকবান্ধব ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একটি ভালো পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবে সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হবে। যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামাজিক সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শহরের অন্তর্ভুক্তিমূলক জনবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর ও স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে মহাপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন প্রতিটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ প্রদান। তাই অতিদ্রুত রাজধানীর সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ প্রদান করে ও মহাপরিকল্পনাগুলো বিশেষত ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্মার্ট সিটি ও বাসযোগ্য ঢাকা নগরী গড়তে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
লেখক : মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল : shahjalalmisuk@gmail.com
বসবাসের অযোগ্য থেকে স্মার্ট ও বাসযোগ্য রাজধানী ঢাকা সম্ভব
মো. শাহ জালাল মিশুক
০৭ জুন ২০২৩, ১৮:৪০:২৫ | অনলাইন সংস্করণ
প্রাণের শহর রাজধানী ঢাকা দিনকে দিন নগরবাসীর কাছে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। বায়ুদূষণ, পানি, শব্দ ও আলোদূষণের পাশাপাশি যানজটে স্থবির জনজীবন। তার ওপর ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি মানুষের চাপে পিষ্ট ‘জাদুর শহর’। কীভাবে এ নগরী আবারও প্রাণ জুড়ানো শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার উপযোগী এবং স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলা যায়— সেটিই বর্তমান সময়ে সর্বমহলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়।
একটি স্মার্ট সিটির লক্ষ্য হলো— প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করা, অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং আরও টেকসই এবং দক্ষ শহুরে পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এমন একটি শহর গড়ে তোলা যা প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখবে। প্রকৃতির সব রূপ গ্রহণ করে এমন একটা সবুজ অবকাঠামো তৈরি করা যাতে শহরের বাসিন্দারা তা উপভোগ করতে পারে। স্মার্ট সিটিতে যা থাকা প্রয়োজন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই প্রয়োজন স্মার্ট পরিবহণ ব্যবস্থা, যা যানজট কমাতে সাহায্য করবে। তার পর প্রয়োজন, স্মার্ট এনার্জি সিস্টেম যা শক্তির অপচয় এবং কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করবে রিয়েল-টাইম ডেটা ব্যবহার করে।
অন্যদিকে স্মার্ট ঢাকা গড়তে স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের গুরুত্ব অপরিসীম, যেখানে নগরীর বর্জ্য সংগ্রহকে অপটিমাইজ করতে এবং আবর্জনা কমাতে সেন্সর ব্যবহার করতে হবে। নগরীতে প্রয়োজন স্মার্ট পাবলিক সেফটি সিস্টেম যা অপরাধের হার কমাতে সাহায্য করবে ডেটা এবং বিশ্লেষণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সর্বপরি, একটি স্মার্ট নগরীতে প্রয়োজন স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যা পানির ব্যবহার নিরীক্ষণ ও পরিচালনা এবং বর্জ্য কমাতে সহায়তা করবে। তাই সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশে বিনির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই জনমনে একটি প্রশ্ন— আদৌ কি সম্ভব ঢাকাকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করা?
তাই নানা বাধাবিপত্তি আর চ্যালেঞ্জ জয় করেই ঢাকাসহ সারা দেশের টেকসই উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। লক্ষ্য— ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল থেকে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই গড়তে হবে স্মার্ট ঢাকা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ কার্যক্রম আবর্তিত হয় এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই। তাই ঢাকা যত দ্রুত স্মার্ট হবে, তত দ্রুতই স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্মার্ট সিটির মূল স্তম্ভগুলো নিয়ে কার্যকরভাবে ঢাকা শহরের জন্য অতিদ্রুত কাজ করতে হবে। স্মার্ট গভর্ন্যান্স, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট মোবিলিটি, স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, স্মার্ট পিপল এবং স্মার্ট লিভিং— এগুলোই স্মার্ট সিটির মূল স্তম্ভ। আর নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী বিষয় আনতে হবে, যাতে মানুষের জীবনযাত্রা আরও সহজ হয়।
গত ৬০-৭০ বছরে তিলোত্তমা নগরী রাজধানী ঢাকার জন্য যেসব পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা, উদ্যোগ, আয়োজন করা হয়েছে, সেগুলোও একেবারে কম নয়। কিন্তু তাতে ঢাকা কি বাসযোগ্য নগরী হয়ে উঠেছে? রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। সেই তুলনায় দেখা যায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে।
ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে প্রায় ৪০০-৫০০ জন। অন্যদিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়। রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করেন ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ। এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ শতাংশ সঠিক ছিল। তবে ৩০ শতাংশ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এর পর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
মোর্দাকথা হলো— রাজধানী ঢাকাকে নাগরিকবান্ধব ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একটি ভালো পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবে সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হবে। যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামাজিক সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শহরের অন্তর্ভুক্তিমূলক জনবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর ও স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে মহাপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন প্রতিটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ প্রদান। তাই অতিদ্রুত রাজধানীর সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ প্রদান করে ও মহাপরিকল্পনাগুলো বিশেষত ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্মার্ট সিটি ও বাসযোগ্য ঢাকা নগরী গড়তে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
লেখক : মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল : shahjalalmisuk@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023