Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

গভর্নরকে প্রধান উপদেষ্টা

ব্যাংক ডাকাতদের আইনের আওতায় আনতে হবে

অর্থনীতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক: অর্থ পাচারে জড়িত ১২ গ্রুপ চিহ্নিত * এস আলম গ্রুপের সব সম্পত্তি জব্দ * ছয় মাসে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি * কাজ শুরু করেছে ‘সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার’

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংক ডাকাতদের আইনের আওতায় আনতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ব্যাংক ডাকাতরা দেশের জনগণের সম্পদ লুট করেছে। এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে রোববার সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, এস আলম গ্রুপের সব সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানি ‘নগদ’-এর বিরুদ্ধেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত ১২টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, অর্থসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ সরকারে নীতিনির্ধারকরা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ৬ মাসে দেশের অর্থনৈতিক অর্জন এবং আগামীদিনের পরিকল্পনা তুলে ধরেন অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান। বৈঠকে জানানো হয়, পতিত সরকারের ফেলে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কমেছে মূল্যস্ফীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য) এবং মাথা পিছু আয় বেড়েছে। তবে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ বিদায়ি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। ওই বছরের আংশিক হিসাবে যা ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেতৃত্বে সব বাহিনীর সমন্বয়ে রোববার ৬টা থেকেই ‘সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার’ কাজ শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এবং অপূর্ব জাহাঙ্গীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। 

শফিকুল আলম বলেন, যারা ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। প্রধান উপদেষ্টা এই নির্দেশ দিয়েছেন। ‘এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন তারা (ব্যাংক ডাকাতরা) যেন আইনের আওতার বাইরে না থাকে। যে করেই হোক তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’ অধ্যাপক ইউনূসের বরাত দিয়ে প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘যারা ব্যাংকের টাকা লুট করেছেন, আসলে তারা দেশের সাধারণ মানুষের টাকা নিয়েছে। তাই যেভাবে হোক তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।’ সভায় অধ্যাপক ইউনূস অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শুরুতে অর্থনীতি খুব বাজে অবস্থায় ছিল। সেই জায়গা থেকে এখন ভালো জায়গায় এসেছে। তবে আরও ভালো জায়গায় নিতে হবে। এটা সরকারের চ্যালেঞ্জ। শফিকুল আলম বলেন, বেক্সিমকোর সঙ্গে কিছু জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। 

উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘প্রবাসী আয়ে ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অভিবাসন বাড়ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এখনই এটা নিয়ে উৎসব করার কিছু নেই। এ খাতে এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া অধ্যাপক ইউনূস অভিবাসন বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যেসব দেশ বর্তমানে বাংলাদেশি অভিবাসনগামীদের ভিসা বন্ধ রেখেছে, তা কীভাবে দ্রুত চালু করা যায়, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। 

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকা উদ্ধারে ইতোমধ্যে এস আলম গ্রুপের সব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নগদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করেছেন, এমন ১২ জন অপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছে।

তারা কীভাবে টাকা নিয়েছেন সেগুলো বের করতে আমরা বিদেশি বিশেজ্ঞদের সহযোগিতা নিচ্ছি। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সব সংস্থা এ নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ওই বৈঠকে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সহযোগিতা দিতে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিনিধি দলও শিগগিরই আসছে। এর বাইরে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে কথা বলছি। এক্ষেত্রে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে-গত ১৫ বছরে দেশ থেকে যে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২৮ লাখ কোটি টাকা) অর্থ পাচার হয়েছে, তা দেশে ফিরিয়ে আনা। এই টাকা কারা নিয়েছেন, কোথায় গেছে-এগুলো চিহ্নিত করতে পারলে কাজ অনেক এগিয়ে যাবে। প্রথমে যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সেখান থেকে এই টাকা কিংবা সম্পদ জব্দ করতে হবে। পরবর্তীতে তা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে। সভায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে এসেছে। এখন আমরা একটা স্থিতিশীল জায়গায় আসছি। বর্তমান যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রিজার্ভের অবস্থা সামনে আরও ভালো হবে। 

সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম আরও বলেন, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সব বাহিনীর সমন্বয়ে ‘সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার’ রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকেই কাজ শুরু করেছে। কমান্ড সেন্টার সমন্বয় করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেন্টারটির সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড, আর্মড ফোর্স ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যুক্ত থাকবেন। রাজধানীসহ দেশের কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে কমান্ড সেন্টার থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ৫ মাসে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে। গত বছরের জুলাইয়ে যা ছিল ১১ শতাংশ। আগামী জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসবে। মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চলতি বছরে নয় লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া পরিশোধে ভর্তুকি ৪০ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর মাধ্যমে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে চলতি বছরে প্রায় ১১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ১০ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কূপ খনন করে দৈনিক ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে তা বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, মিটিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অটোনমি (স্বায়ত্তশাসন) নিশ্চিত করতে বলেছেন।

প্রেস সচিব বলেন, বর্তমানে টাকা ছাপানো এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ আছে। নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় অব্যাহত আছে। দেশের এক কোটি পরিবার ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য পাচ্ছে। ১৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ আছে। যে পরিমাণ মজুদ আছে এবং আমদানি যা হচ্ছে তাতে পণ্যের দাম আরও কমে আসবে। তিনি বলেন, দেশে কোরিয়ান ইপিজেড নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। জমি জটিলতার কারণে তারা বিনিয়োগ করছিল না। পতিত স্বৈরাচারেরা এই সমস্যা তৈরি করেছিল। এখন এই ভূমি সমস্যার সমাধানে সরকারব্যবস্থা নিয়েছে। কোরিয়ান ইপিজেডকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাদের ভূমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে বিনিয়োগে আর কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, এই ইপিজেডে কোরিয়ার অনেক অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে। আশা করছি, সমস্যা সমাধানের ফলে সেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে।

শফিকুল আলম জানান, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা যা ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৩৮ মার্কিন ডলার। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা যা ছিল দুই হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা আসছে। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। পুলিশের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে খুন সবচেয়ে কম। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যেতে যারা সহায়তা করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? জবাবে প্রেস সচিব বলেন, যারা বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের বেশির ভাগই ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে। ওই সময়ে দেশে কোনো সরকার ছিল না। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। পুলিশকে কাজে ফেরাতে অনেক সময় লেগেছে। এর পরও এ অপরাধে কারা জড়িত ছিল, তাদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে।


প্রধান উপদেষ্টা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম