সেমিনারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
মানবিক করিডর নয়, চ্যানেল
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ দেওয়ার জন্যে জাতিসংঘ মানবিক করিডরের প্রস্তাব করেনি; বরং মানবিক চ্যানেলের কথা বলেছে-এমন মন্তব্য করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। আর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না থাকায় এ সময়ের মধ্যে তাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি আরও বলেন, শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সম্ভব নয়। সংকটের এখনো কোনো কার্যকর সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রোববার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : আঞ্চলিক নিরাপত্তায় কৌশলগত প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে উপদেষ্টারা এসব কথা বলেন। ইউনিভার্সিটির স্বাধীনতা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল মো. মাহবুব-উল-আলম স্বাগত বক্তব্য দেন। এছাড়া বক্তব্য দিয়েছেন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালে রাখাইনে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে তৃতীয় দফায় রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এর আগেও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসে। শুরুতে এই সংকট মোকাবিলায় দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ওপর নির্ভরতার সমালোচনা করে উপদেষ্টা বলেন, তিনিসহ অনেকেই সতর্ক করেছিলেন যে এ ধরনের প্রচেষ্টা নিষ্ফল হবে।
দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়াকে ‘বৃথা’ আখ্যা দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। তিনি বলেন, আমরা কূটনীতি ত্যাগ করতে পারি না, কিন্তু আমাদের এই আশা ছেড়ে দিতে হবে। শুধু দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সফল হবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে কোনো প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে এবং নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তারা এমন জায়গায় ফিরে যাবেন না যেখানে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাদের অধিকার অস্বীকার করা হয়।
মিয়ানমারে কখনো গণতন্ত্র ছিল এই ধারণাটি নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, এমনকি অং সান সু চির অধীনেও এটি একটি আধা-সামরিক শাসন ছিল। এখন আমরা যা দেখছি তা হলো পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধ। সামরিকজান্তা, আরাকান আর্মি এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে (এনইউজি) মিয়ানমারের প্রধান অংশীজন হিসাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে কোনো স্থায়ী সমাধানে অবশ্যই এই তিনটি পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে আরাকান আর্মিকে, যারা এখন রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুবিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, মানবিক করিডর নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তাদের একত্রীকরণের মধ্যে নয় বরং তাদের প্রত্যাবাসনের মধ্যে নিহিত। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, তারা প্রায় ভুলে যাওয়া বিষয়টি পুনরুজ্জীবিত করে এবং এটি বিশ্বব্যাপী নজরে আনে।
খলিলুর স্পষ্ট করে বলেন, আমরা মানবিক করিডর সম্পর্কে কোনো আলোচনা বা চুক্তি বা বোঝাপড়া করিনি। এটি কোনো মানবিক করিডর নয়; এটি একটি মানবিক চ্যানেল। করিডর এবং চ্যানেলের সংজ্ঞা আলাদা। তিনি মানবিক করিডরের আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধে জড়াবে এমন গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। খলিলুর আরও বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা তাদের প্রত্যাবাসনের একটি উপায় খুঁজে বের করব।
এটি সহজ হবে না, তবে আমরা এটি বাস্তবায়িত করব। তিনি এই বলে শেষ করেন যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে এবং দেশটিকে অস্থিতিশীল করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব মানবিক সাহায্যের বাইরেও অনেক বেশি। সেমিনারে মূল বক্তা হিসাবে বক্তব্য রেখে তিনি উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কে জড়িত থাকা এবং প্রত্যাবাসনের অব্যাহত অনুপস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটি আর মানবিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও বৈষম্য, প্রান্তিকীকরণ এবং দীর্ঘস্থায়ী বাস্তুচ্যুতির মতো মূল কারণগুলোর সমাধান না হলে এই অর্জনগুলো ক্ষুণ্ন হতে পারে।
