সাক্ষাৎকার: ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ঋণের দুষ্টচক্র ভাঙার চেষ্টা থাকবে বাজেটে
উচ্চাভিলাষী নয়, বাস্তবভিত্তিক হবে * কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সামলানোর উদ্যোগ * নতুন করে মেগা প্রকল্প হবে না
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট হবে ঋণের দুষ্টচক্র ভাঙার। এক্ষেত্রে দেশি ও বৈদেশিক উভয় ঋণের কথাই বলা হচ্ছে। যদিও একেবারে বড় কিছু হবে না। এরপরও ঋণনির্ভরতা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু হবে এই নতুন বাজেট থেকে। এসব কথা জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাজেট হবে দারিদ্র্য কমিয়ে আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি সহ্য করার সক্ষমতা তৈরি এবং বাস্তবভিত্তিক। বাজেটের অন্যতম বড় অংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তৈরির কাজও চলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নয়ন বাজেট খুব বড় না হলেও ফলদায়ক কিছু হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার হামিদ-উজ-জামান।
যুগান্তর : আপনি অর্থনীতিবিদ হিসাবে সব সময় পরামর্শ দিতেন, এখন নিজেই বাজেট তৈরির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। কেমন হচ্ছে বাজেট?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : আমার বাজেট তৈরির অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ছিলাম। তখন একবার ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট তৈরি করেছিলাম। তবে এবারের বাজেট খুব বড় হবে না। বিশেষ করে উন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়বে না। উচ্চাভিলাষী কোনো চিন্তা আমাদের মাথায় নেই। বাস্তবভিত্তিক বাজেট তৈরির কাজ চলছে। যাতে অর্থের সংস্থানমূলক এবং বাস্তবায়নযোগ্য হয় সেই চিন্তা এবং পরিকল্পনা মাথায় রেখেই এডিপি তৈরির কাজ করা হচ্ছে।
যুগান্তর : বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা কি কমবে?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : এবারের বাজেট হবে ঋণের দুষ্টচক্র ভাঙার। এক্ষেত্রে শুধু বৈদেশিক ঋণই নয়, দেশীয় ঋণও যাতে কম নিতে হয় সেই চেষ্টা থাকবে। তবে এক বাজেট দিয়ে তো আর পুরোপুরি সফল হওয়া সম্ভব নয়। আগামী অর্থবছরের বাজেট দিয়ে কাজটা শুরু করা হবে। এই ঋণনির্ভরতা একবারেই কমানো যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি ধীরে ধীরে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার। তাই এর একটি প্রভাব থাকবে নতুন বাজেটে। এছাড়া অর্থ সংস্থানের প্রতিকূলতা এবং ব্যয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হবে আগামী অর্থবছরে।
যুগান্তর : নতুন করে আরও মেগা প্রকল্প আসবে কিনা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোনো মেগা প্রকল্প হবে না। বরং যেগুলো চলমান সেগুলোও যাচাই-বাছাই করে বাস্তবায়নযোগ্য অংশ চলমান রাখা হবে। ঢালাওভাবে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে না। এরপরই প্রয়োজন অনুযায়ী চলতি মেগা প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি যেসব প্রকল্প আগামী অর্থবছরে সমাপ্ত করা হবে বলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কমিটমেন্ট রয়েছে। সেগুলোতে পর্যান্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
যুগান্তর : এডিপি বরাদ্দের ক্ষেত্রে আর কী বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে রাস্তাঘাট তৈরিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বলতে গেলে বিদ্যমান রাস্তাসহ এ সংক্রান্ত অবকাঠামোগুলোর সংস্কার, সংরক্ষণ এবং প্রশস্তকরণসহ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত থোক বরাদ্দ রাখা হবে। কেননা রাস্তা অনেক হয়ে গেছে। কিন্তু এগুলো যদি চলাচলের উপযোগী রাখা না যায় তাহলে প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। অতীতে সরকার গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটির ক্ষেত্রে অবহেলা দেখিয়েছে। যেটি একদম ঠিক হয়নি। এছাড়া রাস্তার নতুন প্রকল্প গ্রহণে যতটা উৎসাহ বা আগ্রহ দেখানো হতো ততটাই অনাগ্রহী ছিলেন সংস্কার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। দেশের অনেক জায়গায় রাস্তার বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক রাস্তায় ব্রিজ ও কালভার্ট ভাঙা আছে। ফলে ওইসব রাস্তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে আছে। আমরা সেসব মেরামতে গুরুত্ব দিচ্ছি। এছাড়া আমরা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন গুরুত্ব দিচ্ছি। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার কাজ চলছে।
যুগান্তর : বাজেটে আর কী বৈশিষ্ট্য আছে?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যাতে করে মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষ বর্ধিত আয় দিয়ে সামলাতে পারে। আগামী অর্থবছরে যাতে মূল্যস্ফীতি কম থাকে সেজন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। গত বছর জুন-জুলাই মাসে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল এবার জুন-জুলাই মাসে এর চেয়েও অনেক কম মূল্যস্ফীতি থাকবে বলে আশা করছি।
যুগান্তর : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমবে কিনা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যে কমবে এটা ঠিক। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে বরাদ্দ পর্যাপ্ত রাখা হবে। কিন্তু নতুন অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়বে না। যেসব অবকাঠামো বিদ্যমান আছে সেগুলো সচল করা এবং পরিচালন খাতে ব্যয় বাড়ানো হবে। অবকাঠামো তৈরি করে ব্যবহার না করাটা একটি বড় অপচয়। এজন্য অব্যবহৃত থাকা অবকাঠামোগুলো ব্যবহারযোগ্য করতে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়া হবে বাজেটে। ফলে সার্বিকভাবে মনে হতে পারে বরাদ্দ কমছে। আসলে সেটি ঠিক নয়। আর একটি বিষয় হলো বেসরকারি শিক্ষকদের জমানো বড় অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেই টাকার কিছু অংশ যাতে তাদের ফেরত দেওয়া যায় সেজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে বন্ড ইস্যু করার ব্যবস্থা রাখা হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে সেই বন্ডের আয়ের টাকা দিয়ে শিক্ষকদের দায় কিছুটা মেটানো যায়। পাশাপাশি নগদ টাকাও কিছু বরাদ্দ রাখা হবে। তবে এত বছরের বঞ্চনা এক বছরের বাজেট দিয়ে তো প্রতিকার সম্ভব হবে না। আমরা বঞ্চনা দূরীকরণের কাজের শুরুটা করে যেতে চাই।
যুগান্তর : বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর নতুন করে ৩০ লাখ অতি দরিদ্র বাড়বে, আপনারা কী করছেন?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : এটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ অনেকেই বলছে দারিদ্র্য হার বাড়বে। কিন্তু আমরা দেখতে চাই প্রকৃত অবস্থা কী, গত দু-তিন বছরে কতটুকু বেড়েছে এবং কী কারণে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। দারিদ্র্য কি কর্মসংস্থানের কারণে বেড়েছে, নাকি কৃষিপণ্যের দাম কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমার কারণে বেড়েছে, নাকি রোগবালাই বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে সেটি খতিয়ে দেখা হবে। প্রকৃত কারণ না জানলে তো প্রতিকারের পন্থা বের করাটা কঠিন। এজন্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে দ্রুত জরিপের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনে বরাদ্দ থাকবে। প্রয়োজনে বাড়তি কর্মসূচির জন্য থোক বরাদ্দ থাকবে। সেটি খাতওয়ারি থাকবে, তবে দরকার হলে আমরা একটি খাত থেকে অন্য খাতে যেতে পারব সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে আমরা কোন কর্মসূচিতে বেশি গুরুত্ব দিতে পারব সেটির বরাদ্দ থাকবে নতুন বাজেটে।
যুগান্তর : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলুন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো থেকে প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগানো হবে। এক্ষেত্রে অনিয়ম, দলীয়করণের ফলে জায়গা পাওয়া এবং অযোগ্যদের বাদ দেওয়া হবে। ফলে যারা প্রকৃত গরিব এবং কর্মসূচিতে থাকার যোগ্য তাদের জন্য মাথাপিছু বাড়তি বরাদ্দের সুযোগ তৈরি হবে।
