Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে দলগুলো একমত

অর্থবিল-আস্থা ভোট ছাড়া স্বাধীনভাবে মতামত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক * সংখ্যানুপাতে স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে বিরোধী দল থেকে রাখতে সম্মত * চূড়ান্ত হয়নি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংসদের উচ্চকক্ষ, নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি * জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব-আলী রীয়াজ * অংশ নেয়নি জামায়াত; আজ আবার বৈঠক

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থবিল-আস্থা ভোট ছাড়া স্বাধীনভাবে মতামত

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে সংসদে মতামত জানাতে পারবেন। মঙ্গলবার দিনব্যাপী রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ নিয়ে দলগুলো একমত পোষণ করে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি অতিরিক্ত লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ না রাখার সুপারিশ করা হয়। দলটি জানায়, এটি নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করে বিএনপি দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে তা সংযুক্ত করার সুযোগ থাকবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চারটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ছাড়াও আসনে সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে বাকি কমিটির অর্ধেকের সভাপতি পদে বসবেন বিরোধী দলের সংসদ-সদস্যরা। ঐকমত্য হয়েছে নারী আসন ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবে। এছাড়া আলোচনা হলেও চূড়ান্ত হয়নি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংসদের উচ্চকক্ষ, নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। আজ সকাল ১১টায় আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসবে কমিশন। এতে মঙ্গলবারের অসমাপ্ত আলোচনাসহ জাতীয় সংবিধান কাউন্সিল (এনসিসি), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এ বৈঠকে জামায়াত অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব। এর আগে কমিশনের বৈঠকে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে জামায়াত একই মত দিয়েছিল।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিএনপি, এনসিপিসহ ২৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মুলতবি বৈঠক শুরু হয়। জামায়াতের প্রতিনিধিদলের জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করলেও দলটির পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ অংশ নেননি। খালি থাকে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের জন্য নির্ধারিত আসন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, বৈঠকে জামায়াত থাকবে না-এ বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। কারণ হিসাবে দলটি বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে জামায়াতকে ‘ইগনোর’ করা হয়েছে বলে মনে করে দলটি। এর প্রতিবাদ হিসাবে তারা বৈঠকে যোগ দেবেন না।

জানা গেছে, কমিশনের পক্ষ থেকে দুই ঘণ্টা পরে হলেও জামায়াতকে বৈঠকে যোগ দিতে অনুরোধ করা হলে তাতেও সাড়া দেয়নি দলটি।

বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি দল ছাড়া অন্যরা বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে একমত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে আবারও এ বিষয়ে আলোচনা হবে।

সংসদের জনগুরুত্বপূর্ণ চারটি স্থায়ী কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে রাখার বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানান আলী রীয়াজ। কমিটিগুলো হলো পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, এস্টিমেটস কমিটি ও পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের অধীন অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতার বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে বলে জানান ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি।

সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ১০০টি স্থায়ী আসন নির্ধারণের বিষয়েও ঐকমত্য গঠনের কথা জানান আলী রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘কোন পদ্ধতি ও কাঠামোতে নারী প্রতিনিধিত্ব থাকবে, সেটা পরবর্তী সময়ে আলোচনা হবে। আশা করছি, আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে।’

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে নীতিগতভাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে বলে জানান আলী রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘দলগুলো মনে করছে, এ বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার দরকার আছে। আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। জুলাইয়ের মধ্যে আমরা জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব।’

আলোচনায় জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব না থাকা প্রসঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আশা করছি, তারা বুধবার (আজ) অংশ নেবে।’

ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমকে দুটি রাজনৈতিক দল পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করছে। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘যে কোনো রাজনৈতিক দল এমন অভিযোগ করতে পারে। তবে আমরা নিরপেক্ষতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব আমাদের কাছে সমান। আমরা মনে করছি, ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখছে। সংস্কার বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

এদিনের বৈঠকে আলোচ্যসূচিতে ছিল সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন, নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সবাই যেন একটা মিনিমাম জায়গায় এসে সংস্কারগুলো সমাপ্ত করতে পারি। জুলাইয়ের মধ্যে যেন জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হতে পারে। তিনি বলেন, জনগণের ভোটে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জনগুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতির পদ আসনের ভিত্তিতে বিরোধী দল পাবে। এর মধ্যে রয়েছে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, এস্টিমেটস কমিটি এবং পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি।

সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন নিয়ে চলমান আলোচনায় সব দল দুটি বিষয়ে একমত হয়েছে। আস্থা ভোট ও অর্থ বিল। এই দুই বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের দলীয় অবস্থান অনুসরণ করতে হবে। তবে এসব বাদে অন্যান্য বিষয়ে সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। বিষয়টি জাতীয় সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে এবং এতে সংশ্লিষ্ট সব দলের সই থাকবে বলেও তিনি জানান।

বিএনপির এই নেতা বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে একটি অতিরিক্ত লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাব এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এটি নির্বাচনের ইশতেহারে উল্লেখ করলে বিএনপি দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে এই বিষয়টি সংযুক্ত করার সুযোগ থাকবে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১০০টি আসন রাখার ব্যাপারেও সবাই একমত হয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে এই আসনগুলোর নির্বাচনি পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, জাতীয় সংসদে যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থাকে, সেই কমিটিগুলোতে আনুপাতিক হারে ৫০ ভাগ বিরোধী দলের পদ দেওয়ার কথা হয়েছে।

তবে সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম। যা নিয়ে কয়েকটি দল প্রতিবাদ জানায়। উত্তেজনা ছড়ায় সভাস্থলে।

আরিফুল রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসাবে যখন একটি প্রস্তাবের দিকে হেলে যান এবং যে প্রস্তাবটি দিয়েছে বিএনপি। ফলে আমরা মনে করি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছে, কোন বিষয়গুলো থাকবে সে বিষয়ে কিছুটা তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

আলোচনায় জাতীয় সংসদে নারী আসন নির্ধারণের বিষয়ে এনসিপির মতামত তুলে ধরে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, নারীদের আসন ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হোক। তবে পদ্ধতি এবং সংখ্যা নিয়ে আলোচনা চলমান আছে।’

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এনসিপির অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে অন্য বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে বলে আমরা মত দিয়েছি।’

বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম