Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বস্ত্র ও পোশাক খাতের সম্ভাবনা ও করণীয়

Icon

ড. মোহাম্মদ আলী

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বস্ত্র ও পোশাক খাতের সম্ভাবনা ও করণীয়

বাংলাদেশ যখন ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্বলতা কাটিয়ে আর্থিক খাতকে অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় এনেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ আরোপিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পালটা শুল্ক ব্যবস্থা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত-বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বিশ্ববাজারে, বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই (৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ১ম অবস্থানে থাকা চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে তাদের ক্রয়াদেশের কিছু অংশ অন্য দেশে স্থানান্তর করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ঝুঁকি মোকাবিলা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের গবেষণা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানি বেড়ে ১ হাজার ১২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। বর্তমানে চীন ৬২ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৫৬ শতাংশ, তুরস্ক ৪৮ শতাংশ, ইতালি ৪৪ শতাংশ কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২৭ শতাংশ হচ্ছে কৃত্রিম তন্তুর পণ্য, যার সুতা ও কাপড়ের ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিন টন কৃত্রিম তন্তু আমদানি করে। মার্কিন আমদানিকারকরা চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করলে তার উল্লেখযোগ্য পণ্য হবে কৃত্রিম তন্তুর। কৃত্রিম তন্তু, সুতা ও কাপড়ের আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশেই কৃত্রিম তন্তু উৎপাদন প্রয়োজন। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল বা পেট ফ্লেক্স ভারত, থাইল্যান্ড ও চীনে রপ্তানি না করে তা দিয়ে রি-সাইকেল পলিস্টার তন্তু তৈরি করা এবং পলিস্টার তন্তুর কাঁচামাল আমদানি করে ভার্জিন পলিস্টার তন্তু উৎপাদন করা যেতে পারে। এছাড়া পাট থেকে ভিসকোস উৎপন্ন করার অর্থনৈতিক ও কারিগরি উপযোগিতা যাচাই করা হলেও দেশে এখনও ভিসকোস তৈরির কারখানা গড়ে ওঠেনি।

কৃত্রিম তন্তুর পাশাপাশি পোশাক শিল্পের কাপড়ের জন্য সুতা তৈরিতে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৮০ লাখ বেল (১ বেল=২০০ কেজি) তুলা আমদানি করে। বাংলাদেশ প্রধানত আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করে। তুলা আমদানিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। তুলা উৎপাদনে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম এবং দেশের ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে প্রায় ২ লাখ বেল তুলা উৎপাদিত হয় যা মোট চাহিদার ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বিঘা জমিতে মোট ২০ মন তুলা হয় যার আর্থিক মূল্য অন্যান্য ফসলের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় তুলা চাষ কৃষকের জন্যও লাভজনক। ব্রিটিশ ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাইমার্ক সাস্টিনেবল কটন প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের উৎপাদিত তুলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের অনাবাদি আখ ও তামাক চাষ করা জমিতে তুলা চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তুলার মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ তুলা আমদানি করে থাকে, যার পরিমাণ বৃদ্ধি করে একটি বাণিজ্যিক সমঝোতার পথ তৈরি করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ ও কম মূল্যে পোশাক তৈরির জন্য প্রধান যে দুটি সুবিধা ছিল, তা হলো কম মজুরি ও কম বিদ্যুৎ মূল্য। পোশাক তৈরির জন্য সুতা, কাপড় উৎপাদন ও কাপড় প্রক্রিয়ার জন্য রয়েছে পশ্চাদমুখী বস্ত্রশিল্প, যেমন-স্পিনিং, উইভিং, নিটিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিসিং। এ পশ্চাদমুখী শিল্পগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে পশ্চাদমুখী বস্ত্র শিল্পের নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য প্রতি ইউনিটের দাম করা হয় ৩০ টাকা। পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। এপ্রিল ২০২৫ থেকে এটি বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা। আর শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা। গ্যাসের এ মূল্য বৃদ্ধি উৎপাদিত পণ্যে যোগ হলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিশ্ববাজারে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পশ্চাদমুখী বস্ত্রশিল্পগুলোকে নানামুখী বিদ্যুৎ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিদ্যুতের অপচয়রোধে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুতের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে।

তৈরি পোশাক শিল্পের সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কয়েকটি দিক রয়েছে, যেমন-শ্রমিক উৎপাদনশীলতা, মেশিন উৎপাদনশীলতা, ও কাঁচামালের উৎপাদনশীলতা। উৎপাদনশীলতার এ বিশেষ তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো, যেমন-ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা পাকিস্তান ও তুরস্কের তুলনায় পিছিয়ে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রয়োজন কারখানার যথাযথ কর্মপরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনশীলতার সহযোগী কিছু স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক সুবিধা প্রদান। এছাড়া শ্রমিকের কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহারের জন্য নজরদারি বাড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। একইভাবে মেশিনের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য মেশিন তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। আর কাঁচামালের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে কাঁচামাল অপচয় রোধকল্পে সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং কাঁচামালের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

ওপরে আলোচিত দিকগুলো ছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ জরুরি। কারিগরি পোশাক বা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, যেমন-চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় মেডিটেক, কৃষি ও মৎস্য খাতে অ্যাগ্রটেক, নির্মাণ খাতে বিল্টটেক, পরিবহণ খাতে অটোমোবাইল টেক, খেলাধুলার সামগ্রীর জন্য স্পোর্টসটেক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জিওটেক, বিভিন্ন শিল্পের ইন্ডাস্ট্রিয়ালটেক ছাড়াও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মিলিটারি ও ডিফেন্স খাতে পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।

সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে কঠিন প্রতিযোগিতা করতে হবে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে, কারণ এ দুটি দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম শুল্ক আরোপ করেছে (ভারতের পণ্যে ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানের পণ্যে ২৯ শতাংশ)। বিশেষ করে ভারতের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের সক্ষমতার কারণে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হবে। বাংলাদেশে জুলাই-২৪ আন্দোলনের পর থেকেই ভারত তাদের বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের রপ্তানি শক্তিশালী করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতেও (এফটিএ) তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপের বাজারে আরও কয়েক বছর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে তিন মাস শুল্ক স্থগিত এবং চীনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ বন্ধের সমঝোতার ইঙ্গিত থাকলেও বাংলাদেশ যদি তৈরি পোশাক রপ্তানির ঝুঁকি, সম্ভাবনা ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে, তবে তা হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে একটি বড় অর্জন।

ড. মোহাম্মদ আলী : অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইনঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ ট্রেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

বস্ত্র

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম