নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার যুগে বিশ্ব
‘চোখের পলকে’ বাড়ছে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দিন যত যাচ্ছে সামরিক শক্তিতে ততই এগিয়ে যাচ্ছে চীন। ‘চোখের পলকে’ বাড়ছে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা। ২০২০ সাল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোর বিশাল সম্প্রসারণ করেছে বেইজিং। ফলে দেশটির সামরিক সক্ষমতা ও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বহুগুণে বেড়ে গেছে। সিএনএনের স্যাটেলাইট ছবি, মানচিত্র এবং সরকারি নথির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই তথ্য।
চীনের ১৩৬টি স্থাপনাকে বিশ্লেষণ করেছে সিএনএন। তার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি জায়গায় সম্প্রসারণ দেখা গেছে। এই স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কারখানা, গবেষণা কেন্দ্র ও পরীক্ষাগার। এসব নির্মাণ এলাকায় ২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত ২১ মিলিয়ন বর্গফুট (প্রায় ২০ লাখ বর্গমিটার) সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে নতুন টাওয়ার, বাঙ্কার ও মাটির বেড়াজালের মতো কাঠামো দেখা গেছে। এমনকি কিছু ছবিতে মিসাইলের অংশও চোখে পড়েছে। প্যাসিফিক ফোরামের সিনিয়র ফেলো ও সাবেক ন্যাটো অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ পরিচালক উইলিয়াম আলবেরকে বলেন, ‘এটা হচ্ছে চীনের বিশ্বশক্তি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি। আমরা নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রাথমিক ধাপে আছি। চীন এখনই দৌড়াচ্ছে এবং তারা দীর্ঘ প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
সিএনএনের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য :
চীনের প্রধান দুটি রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা হলো- চায়না অ্যারোস্পেস সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল করপোরেশন (সিএএসসি) এবং চায়না অ্যারোস্পেস সাইন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন (সিএএসআইসি)। সিএনএন ৯৯টি মিসাইল উৎপাদন কেন্দ্র শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে ৬৫টি সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া রকেট ফোর্সের ৩৭টি ঘাঁটির মধ্যে ২২টি গত পাঁচ বছরে বড় হয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পেন্টাগন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চীনের রকেট ফোর্স গত চার বছরে মিসাইল সরবরাহ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। সিএনএনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সেই গতি ২০২৫ সালেও অব্যাহত আছে। চীন এ বছর তার প্রতিরক্ষা বাজেট ৭.২ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ডলার করেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রকৃত ব্যয় সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।
চীনের সামরিক রূপান্তর ও রকেট ফোর্সের উত্থান :
২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার লক্ষ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। তিনি চীনা সেনাবাহিনী বা পিপলস লিবারেশন আর্মিকে ‘বিশ্বমানের যুদ্ধশক্তি’তে রূপ দিতে চান বলে জানিয়েছেন।
চীনের সেনাবাহিনীতে বর্তমানে ২০ লাখেরও বেশি সক্রিয় সদস্য রয়েছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনী।
তাইওয়ানকে ঘিরে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিকল্পনা :
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রসারিত এসব কারখানায় তৈরি মিসাইল হবে তাইওয়ান আক্রমণের সম্ভাব্য অভিযানের মূল অস্ত্র। বেইজিং তাইওয়ানকে নিজের অংশ বলে দাবি করে। চীনের কৌশল হলো- ‘অ্যান্টি-অ্যাকসেস/এরিয়া ডিনায়াল’ নীতি অনুসরণ করে এমন এক অঞ্চল তৈরি করা, যাতে মার্কিন নৌবাহিনী তাইওয়ানের কাছাকাছি আসতেই না পারে। গবেষক ডেকার ইভেলেথ বলেন, ‘চীনের লক্ষ্য হলো তাইওয়ান আক্রমণের শর্ত তৈরি করা। তারা বন্দরে, ঘাঁটিতে, হেলিকপ্টার বেজে এবং সরবরাহ কেন্দ্রে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে। তারা চায় অভ্যন্তরীণ মঞ্চে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে এবং বাইরের শক্তিকে বাইরে রেখেই অভিযান চালাতে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ঘাটতি ও প্রতিরক্ষা সমস্যা :
চীনের এই উত্থানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ও ইসরাইলকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের অস্ত্র মজুতের বড় অংশ খরচ করে ফেলেছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থার্ড সিস্টেমের ২৫ শতাংশ ইন্টারসেপ্টর ব্যবহার করেছে। একটি থার্ড ক্ষেপণাস্ত্রের দাম প্রায় ১২.৭ মিলিয়ন ডলার এবং তৈরি করতেও দীর্ঘ সময় লাগে। এই ঘাটতির মধ্যে চীনের দ্রুত উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য উদ্বেগজনক সংকেত।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শেখা :
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের (২০২২) পর চীন মিসাইল কারখানা সম্প্রসারণের হার প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এ বিষয়ে আলবেরকে বলেন, ‘তারা ইউক্রেন যুদ্ধ খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা দেখছে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন দুই দেশের বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র কেমন চলছে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।’
রাশিয়ার কৌশল ছিল সস্তা ড্রোন দিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল করে তারপর ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে আঘাত করা। চীনের বিশ্লেষকরা মনে করছেন- এই পদ্ধতিই ভবিষ্যতের যুদ্ধের রূপরেখা।
চীনের ধারণা ছিল, তাইওয়ানকে পরাস্ত করতে ৫-১০ হাজার মিসাইল যথেষ্ট হবে, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর তারা ধারণা করছে এখন এ প্রয়োজন কয়েকগুণ বেশি।
অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও সামরিক প্রস্তুতির প্রশ্ন :
তবে চীনের ভেতরেও সমস্যা আছে। রকেট ফোর্সসহ সামরিক ক্রয়-বিক্রয়ের দুর্নীতির কারণে গত দুই বছরে দুজন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ বহু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘চীন বুঝেছে যে দুর্নীতি তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নির্ভরযোগ্যতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
বিশ্ব নিরাপত্তায় প্রভাব ও ঠান্ডা যুদ্ধের আশঙ্কা :
চীনের এই দ্রুত সামরিক সম্প্রসারণ বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্যাসিফিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সান্তোরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, ঠান্ডা যুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এটা এখন সবক্ষেত্রে চলছে। অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সামরিক এবং এর ঝুঁকি হলো এটা একসময় কঠিন যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে।’
