কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন
অভিনব জালিয়াতি ঋণের নামে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১০ এএম
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঋণের নামে অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। প্রভাব খাটিয়ে অন্যের কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করে সেই অর্থ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। ওইসব ঋণের সুবিধাও ভোগ করেছেন। এমন বেআইনি কর্মকাণ্ডে সংশি্লষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বাধা না দিয়ে উলটো সহায়তা করেছেন। এ ধরনের ঋণের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। আরও ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপির পথে। নজিরবিহীন অভিনব জালিয়াতি করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদের এস আলম গ্রুপ, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক, নাসা গ্রুপের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংক ও বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এবি ব্যাংকে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ওইসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ একটি ঋণের দায় স্বীকার করেছে।
কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকের গুলশান এক শাখা থেকে ৯৫০ কোটি
টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে নাবিল গ্রুপের ট্রেডিং কোম্পানি Èমার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজার'-এর নামে। সরেজমিন তদনে্ত
এ কোম্পানির কোনো অসি্তত্ব পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তারা এটিকে একটি
ভুয়া কোম্পানি হিসাবে অভিহিত করেছে। এই কোম্পানির নামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক
ঋণ নেওয়া হয়েছে। নাবিল গ্রুপের কোম্পানির নামে ঋণের অনুমোদন হলেও টাকা এককভাবে নাবিল
গ্রুপের হিসাবে যায়নি। এর মধ্যে নাবিল গ্রুপ পেয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা। বাকি ৪০০ কোটি
টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। অর্থাত্ নাবিল গ্রুপের নামে ঋণ অনুমোদন করে টাকা নিয়েছে
এস আলম গ্রুপ। এভাবে নাবিল গ্রুপের নামে অনুমোদন করা ঋণের একটি অংশ এস আলম গ্রুপ নিয়ে
গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এ
প্রসঙ্গে নাবিল গ্রুপ জানিয়েছে, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের
যোগসাজশে জোরপূর্বক ক্ষমতার দাপটে নাবিল গ্রুপের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামে
টাকা তুলে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
প্রতিবেদনে
বলা হয়, ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শাহ আলম নাবিল গ্রুপের একজন
কর্মচারী। ২০২২ সালের ১৪ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখায় তিনি ওই কোম্পানির নামে
ঋণের আবেদন করেন। এরপর কোম্পানির নামে একটি হিসাব খুলেন ওই শাখায়। প্রধান কার্যালয়ের
অনুমোদন নিয়ে ১০ আগস্ট ঋণের টাকা ছাড় করা হয়। ঋণটি ছিল এলটিআর বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে
ঋণ। কোনো রকম জামানত ছাড়াই ঋণটি দেওয়া হয়। ঋণের মেয়াদ ছিল এক বছর। অর্থাত্ ২০২৩ সালের
১০ আগস্টের মধ্যেই ঋণের টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু পরবর্তী এক বছরে কোনো কিসি্ত
পরিশোধ করা হয়নি। ফলে এটি খেলাপি হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর পাওনা টাকার আড়াই
শতাংশ হিসাবে ২৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণটি নবায়ন করা হয়। শর্ত ছিল
মুনাফাসহ কিসি্ত পরিশোধ করবে। কিন্তু কোনো কিসি্ত পরিশোধ করেনি।
প্রতিবেদনে
বলা হয়, আলোচ্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাংক নূ্যনতম দায়িত্ব পালন করেনি। শাখা থেকে
প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত সব স্তরেই অনিয়ম হয়েছে। মানি লন্ডারিং আইনের বিধান ভঙ্গ করে
ভুয়া কোম্পানির নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। এ অনিয়মের সঙ্গে শাখা পর্যায় থেকে
ব্যাংকের পর্ষদ পর্যন্ত সব স্তরের কর্মকর্তার সায় ছিল। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ অনুমোদন ও
অর্থছাড় করাকে ব্যাংকিং নিয়মনীতির লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে
এ ধরনের ঘটনা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও শাসি্তযোগ্য অপরাধ।
উত্তরা
গ্রুপের একটি কোম্পানির নামে বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ৯০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন
করা হয়। এর অর্থ পুরোটাই কয়েকটি হিসাব বদল হয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের এক হিসাবে স্থানান্তরিত
হয়। পরে ওই হিসাব থেকে টাকা তুলে নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদনে্ত
এটিকে বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি ঋণ হিসাবে উলে্লখ করা হয়। পরে ঋণের দায় বেক্সিমকো
গ্রুপ স্বীকার করে নেয়। কিন্তু ঋণের কোনো কিসি্ত পরিশোধ করেনি বেক্সিমকো। উলটো
আবেদন করে ঋণের নতুন করে সীমা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে নতুন ঋণ
নিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এ ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করার
ক্ষেত্রে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল। ঋণের
কোনো কিসি্তই পরিশোধ করা হয়নি। ফলে ঋণটি এখন খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
নজরুল
ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ তারই মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ
নিয়েছে বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে। এই ঋণের সুবিধাভোগী শুধু নাসা গ্রুপ ছিল না। এই
টাকার একটি অংশ গেছে বেক্সিমকো গ্রুপের হিসাবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে
কোনো পর্যায়েই শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশি্লষ্ট কর্মকর্তারা ব্যাংকিং রীতিনীতি
মানেননি। ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংক কর্মকর্তারা কোম্পানির কোনো
অসি্তত্ব সম্পর্কেও খঁোজখবর নেয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে।
ঋণের কোনো কিসি্ত পরিশোধ না করায় ঋণটি এখন খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত।
কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে আলোচিত তিন ব্যবসায়ীর
গ্রুপসহ আরও কিছু গ্রুপের ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ
করেনি। সংশি্লষ্ট ব্যাংকগুলোয় চাপ প্রয়োগ করে তারা নিজেদের মতো করে ঋণ নিয়েছে। ব্যাংক
যেমন কোনো বাধা দেয়নি, তেমনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো বিধিবিধান প্রয়োগ করেনি।
জেনেও না জানার ভান করে থেকেছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে এসব জালিয়াতিতে
সায় ছিল। যে কারণে নিচের স্তরের কেউ কিছুই বলেননি। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা
এসব জালিয়াতির ঋণ ছাড় করে নিজেরা পদোন্নতি বাগিয়েছেন। বাধা দিলে চাকরিচু্যত হতে হয়েছে।
