জনরায়ের ভয়ে নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে: তারেক রহমান
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাষ্ট্র, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কার এবং নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, কোনো কোনো মহল থেকে সংস্কার নাকি নির্বাচন, এ ধরনের জিজ্ঞাসাকে বিএনপি, দেশপ্রেমিক জনগণ ও সব রাজনৈতিক দল স্রেফ অসৎ উদ্দেশে তর্ক বলে মনে করে। বরং বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন। বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করতে সংস্কার একটি অনিবার্য ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একইভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টেকসই এবং প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে নির্বাচন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর পন্থা।
তারেক রহমান বলেন, ‘বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বচ্ছ। জনগণ কোন রাজনৈতিক দলকে গ্রহন করবে কিংবা বর্জন করবে নির্বাচনের মাধ্যমে সেই রায় দেবে জনগনের আদালত। তবে যারা জনগনের আদালতের রায়ের মুখোমুখি হতে ভয় পায় কিংবা যাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে তারাই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।’
বুধবার বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ছাত্রদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। মিলনায়তন ছাড়াও ইন্সটিটিউশনের বাইরেও প্যান্ডেল টানানো হয় এবং বড় পর্দার স্ক্রিন স্থাপন করা হয়। বাহিরে হাজারো নেতাকর্মী অতিথিদের বক্তব্য শুনেন। এর আগে দুপুর থেকেই খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সভাস্থল এলাকায় ভীড় করেন। বেলা ২টায় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে এ আলোচনা সভা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন নেতাকর্মীরা। এর আগে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনটির পতাকা উত্তোলন এবং পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে দলটির পক্ষ থেকে শোক প্রস্তাব পাঠ ও সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করা হয়। এর আগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সেখানেও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভায় জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আপনারা ধৈর্য হারাবেন না, নির্বাচনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকুন। নির্বাচন কমিশন তাদের অর্পিত দায়িত্ব যথারীতি পালন করবে সেই বিশ্বাস রাখুন।’
দলের নেতা-কর্মৗদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। বরং সর্তক থাকবেন। নিজেরা এমন কোনো কাজে সম্পৃক্ত হবেন না যাতে কেউ অপপ্রচারের সুযোগ পায়। নিজেদেরকে জনগণের আস্থায় রাখুন। জনগনের আস্থায় রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন।’
তারেক রহমান বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের যে সুযোগ পায়, যেটি রাষ্ট্র জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করে। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্রে জনগণের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষমতার নিশ্চিত করা না গেলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা পুঁথিগত সংস্কার শেষ পর্যন্ত কোনো কিছু টেকসই হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম অবশ্যই প্রয়োজন। এই কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো তাদের দৃষ্টিতে অনেক বড় বড় সংস্কার হাতে নিয়েছে। তবে এসব সংস্কার কর্মসূচির আড়ালে জনগণের নিত্যদিনের দুর্দশা বাড়তে থাকলে জনগণ হয়তো সরকারের সংস্কার নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হবে। ইতোমধ্যে জনগণের মনে প্রশ্ন উঠেছে, পলাতক স্বৈরাচারের আমলে সৃষ্ট বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার ভেতর আনতে সরকার কি কী পদক্ষেপ নিয়েছে? ফ্যাসিস্ট আমলের দায়ের করার লাখ লাখ মামলায় এখনো কেন মানুষকে আদালতের বারান্দার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে?
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সংস্কার বা গৃহীত পরিকল্পনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিলে ষড়যন্ত্রকারীরা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বিনষ্ট করার সুযোগ নেবে। এরই মধ্যে তারা একাধিকবার দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। হাজারো ছাত্র জনতার রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা দেশে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি দেখতে চায় না। এই কারণে জনগনের পক্ষের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই সরকারের প্রতি অব্যাহত রেখেছে।
তারেক রহমান আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র, রাজনীতি, সরকার প্রচলিত বিধি ব্যবস্থা সংস্কার করে আরও উন্নত বিধি ব্যবস্থার পক্ষে ছাত্র-তরুণরা অবস্থান নেবে, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে দেশের তরুন জনশক্তি ভুমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তারুণ্যে ধর্ম। দেশে প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটবে এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রয়োজনে বিএনপি সব গণতান্ত্রিক উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। বিএনপি তার জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সকল পরিস্থিতিতে সকল সময়ে বহু দল ও মতের চর্চার পক্ষে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এই সংকটের একমাত্র সমাধান হতে পারে একটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এটা ইতিহাসে প্রমাণিত। কিন্তু আজকে দূর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে আবারও সেই চক্রান্ত্রের খেলা শুরু হয়েছে। যেটা অতীতেও হয়েছে বহুবার। চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া হবে না।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আর বিলম্ব না করে, অতি দ্রুত একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের মানুষকে এই সংকট থেকে মুক্তি করতে হবে। মানুষকে সামনের দিবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আজকে যারা বলেন বিএনপি সংস্কার চায় না, তারা ইতিহাস ভুলে গেছে। ৩১ দফা নিয়ে আমাদের নেতারা গ্রামে গ্রামে গেছে। সংস্কারের মধ্যদিয়ে বিএনপির জন্ম হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছেন। বাকশাল থেকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিয়ে এনেছেন। আমরা মনে করি, সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার আনতে হবে। সংস্কারের নাম করে এমন কিছু হতে দিতে পারি না, যেটা আমাদের গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাকে তাড়িয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমরাই তৈরি করেছি। আমরা আশা করছি, এই সরকার নূন্যতম যে সংস্কার প্রয়োজন, নির্বাচনী লেভেল ফিল্ড তৈরি করা, প্রশাসন যন্ত্র ঠিক করা, বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কারের মধ্যে নিয়ে আসা এবং নূন্যতম অর্থনীতির সংস্কার গুলো করে তার মধ্যে দিয়ে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। যেটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
‘মার্চ ফর ইউনিটি’র নামে কেন সমাবেশ করতে হলো-এ প্রশ্ন তুলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তিনি বলেন, ইউনিটির (ঐক্য) নামে এ ধরনের সমাবেশ, বক্তব্য, ষড়যন্ত্রকারী, লুটপাটকারী ও ফ্যাসিবাদীদের জন্য সহায়ক নয় কি? এ্যানি বলেন, ‘মার্চ ফর ইউনিটির সমাবেশে আমরা লক্ষ করেছি, তাদের মুখ থেকে কী ধরনের বাক্য এসেছে, কী ধরনের বক্তব্য এসেছে, তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ (শারীরিক ভাষা) কী ছিল। আমাদের প্রশ্ন, কী কারণে ইউনিটির নামে মিটিং করতে হয়?’
তিনি বলেন, ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মার্চ ফর ইউনিটির সমাবেশে বেশ কিছু পোস্টার দেখা যায়। তাতে কোনটিতে ‘ভোট ভোট করে যারা, লুটপাটে ব্যস্ত তারা’, ‘কাদের + মির্জা ভাই ভাই, বাংলাদেশে শান্তি নাই’, ‘চাচার বয়সী ছাত্র যারা, বাংলাদেশ গড়বে কেমনে তারা’ ইত্যাদি উলেখ ছিল। তিনি বলেন, ‘সেই মিটিংয়ে কেন এ ধরনের বক্তব্য, পোস্টার, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আপনাদের মধ্যে আসবে?’ তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা ঐক্য চাই। বিগত সরকারের সব গুম, খুন, অন্যায়-অত্যাচারের বিচার চাই। আমরা সবার আগে শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিচার চাই।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের সভাপতিত্বে ও সাধারন সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, রকিবুল ইসলাম বকুল, আজিজুল বারী হেলাল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, হাবিবুর রশীদ হাবিব, আকরামুল হাসান, ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল, কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, রাশেদ ইকবাল খান, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, ঢাকা বিশ্ববিদ্য্যালয় ছাত্রদলের গণেশ চন্দ্র রায় সাহস প্রমুখ।
আলোচনা সভার আগে বেলা সাড়ে ১২টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের সামনে রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম।
