Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ

জলীয় বুদ্ধিজীবী ও তরল সমাজ

Icon

রেজাউল করিম রনি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জলীয় বুদ্ধিজীবী ও তরল সমাজ

কোন ধরনের সমাজে দৃঢ় চৈতন্যবোধ-সমৃদ্ধ মানুষ তৈরি হওয়া কঠিন জানেন? এবং কোন ধরনের সমাজ অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরও সবচেয়ে বেশি হতাশার জন্ম দেয়? এর একটা সহজ উত্তর হলো লিকুইড বা তরল সমাজ। এ ধরনের সমাজ গঠিত হয় বিপুল লিকুইড বা তরল লোকের সমন্বয়ে। আজকে এ বিষয়টা নিয়ে আমরা একটু সংক্ষেপে কথা বলব। আশিস নন্দী এক আলাপে বলেছিলেন, ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে, আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন কৌশলী আক্রমণের সামনে আত্মসত্তা হারাবার সমস্যাটির জন্য স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কম কার্যকরী।’

বাংলাদেশে আমরা যে একটা ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী শাসন দেখলাম এবং অত্যাচারিত হওয়ার সংস্কৃতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল এটা কীভাবে হয়েছে সেই প্রক্রিয়াটা যদি আমরা বুঝতে না পারি, তা হলে এ প্রক্রিয়া থেকে সমাজকে বের করা যাবে না। বিপুলভাবে মানুষ আত্মসত্তা বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিল। লীগের আমলে চারদিকে সব আওয়ামী লীগ হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে যারা ছিল তারা ছিল মজলুম। অনেকে মজলুম হওয়ার ভয়ে বা মজলুমত্ব এফার্ট বা মেনে নেওয়ার বদলে জালেমের সঙ্গে মিশে যাওয়াকে কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছে। অনেকে চুপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যারা জালেমের তালে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকার পথ বেছে নিয়েছে তারা নাগরিক তো বটেই তার হিউম্যান বা মানবিক মর্যাদা বোধের সঙ্গে আপস করেছে। আর যারা জালেমের সহায়ক বা সহযোগিতাকারী হয়ে উঠেছিল তারা সরাসরি অন্যায়ের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। সক্রেটিস মনে করেন, জেনেশুনে অন্যায় করলে মানুষের আত্মা কমে যায়। মানুষের পরম সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। এমন একটা অবস্থার অবসানের জন্য আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের যে জীবন দিতে হলো-এটা আমাদের কালেকটিভ অন্যায়ের শাস্তি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের হারালাম। এ ক্ষতি অপূরণীয়।

কিন্তু ফ্যাসিবাদের পতনের পর দেখছি কোথাও লীগ নেই। লীগময় চারপাশ লীগশূন্য হয়ে যায়নি। বিপুল অংশ আবার নতুন করে এডাপ্ট করা শুরু করেছে। চরম ক্রিমিনালও অভ্যুত্থানের সৈনিক পরিচয় দিয়ে নতুন করে অন্যায়ের দোকান খুলে বসতে চেষ্টা করছে। চারদিকে লীগ ছিল। এখন নেই। অন্তত যারা অপরাধ করেনি। লীগকে আদর্শ বা রাজনীতি মনে করে ভুল করেছে সেটা স্বীকার না করে সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা এবং সুযোগ বুঝে যখন যেমন তখন তেমন থাকা-এ অবস্থাই লিকুইড সমাজের উদাহরণ। যদিও দার্শনিকভাবে এ আইডিয়াটা আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। আমি ছোট করে আমাদের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এ ধারণাটির আমাদের উপযোগী একটা সরল ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করছি। যা হোক, এ বিপুল আত্মপ্রতারক মানুষ দিয়ে উন্নত জাতি হয় না। মানুষমাত্রই অন্যায় করবে তা নয়, কিন্তু ভুল করতে পারে। ভুল জিনিস বিশ্বাসও করতে পারে। কিন্তু তারপর ভুল স্বীকার করে নিজেকে শুধরে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া তাতে শামিল না হয়ে যেমন ট্রেন্ড তেমন হয়ে যাওয়া মানুষ রাজনীতি, দল ও সমাজের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা কোনো নীতির আলোকে নিজের জীবন পরিচালিত করে না। জীবন পরিচালিত করে নগদ ধান্ধা বা লাভের হিসাব মাথায় রেখে। যা মানুষের পরম বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।

লিকুইড মডার্নিটি বা সোসাইটি ধারণাটি আমি প্রথমে পেয়েছি উমবার্তো একো’র ক্রনিকেল অফ এ লিকুইড সোসাইটি নামক প্রবন্ধ সংকলনটি পড়তে গিয়ে। তিনি তার লেখার শুরুতে জানাচ্ছেন, একো এই ধারণাটা পেয়েছেন জিগমুন্ট বাউম্যান-এর কাছ থেকে। যিনি ছিলেন একজন পোলিশ-ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। এ ‘লিকুইড’ ধারণাটি বাউম্যান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। তার চার-পাঁচটা বইয়ের টাইটেলে এ শব্দটি আছে। লিকুইড লাভ, লিকুইড মডার্নিটি, লিকুইড লাইফ ইত্যাদি অন্যতম। আজ এগুলা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটা দিকে এ আলাপটা সীমাবদ্ধ রেখে লেখা শেষ করতে হবে। তা হলো আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের এই যে পরিণতি। এই যে করুণ অবস্থা। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে শাসক। এ অবস্থা আমাদের কথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতার ফল। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যদি দরবারি বুদ্ধিজীবী না হয়ে জাতীয় হতে পারতেন, তা হলে জাতি হিসাবে আমাদের বিকাশ হতো। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এই ৫৫ বছরে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে যেত। এরা চিন্তা ও চৈতন্যের নিগূঢ় সততার পরীক্ষায় ফেইল করেছেন। বিরল ব্যতিক্রমবাদে আমাদের বুদ্ধিজীবিতা বিক্রি হওয়ার জন্য বসে থাকে। লম্বা সময় ফ্যাসিবাদের পক্ষে থেকে হুট করে দল পরিবর্তন করে জাতির বিবেক সেজে নসিহত দিতে শুরু করে। এদের পরিবর্তন হওয়ার ক্ষমতা দেখলে ঘূর্ণিবায়ুও লজ্জা পাবে। এরাই গোটা সমাজের ম্যুরাল বা নৈতিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় এবং সামাজের ফ্যাসিবাদী রূপান্তরের কারিগর।

এ ধরনের জলীয় বুদ্ধিজীবী ছাড়াও আপনি সমাজে এমন অনেক লোক পাবেন যারা-কাঁঠাল পাকার আগেই কোয়া (কোষ) গুনতে শুরু করবে। আর শুধু গোঁফে না সর্ব অঙ্গে তেল মেখে রেডি হয়ে বসে থাকবে। এ টাইপের লোকদের আপনি কীভাবে ঠেকাবেন?

বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো-এরা অতি লিকুইড, যখন যেমন তখন তেমন। অবস্থা বুঝে যে কোনো পাত্রে ধরে যায়। এখন যেমন চারদিকে বিএনপি-জামায়াত ও ইউনূসভক্ত তৈরি হওয়ার মৌসুম শুরু হয়েছে।

এই নব্য ভণ্ড ভক্তকুল হেন কোনো অপকর্ম নেই যা লিড দিচ্ছে না। গত ১৫ বছর সিসটেমের বাইরে থাকা লোকগুলোকে এখন পথ চিনিয়ে যারা নিজেদের পকেট তাজা করছেন তারা লীগের সময়ও এ কাজই করেছেন। তারা লীগের কোলেই ছিলেন এত দিন। এজন্য দেখবেন সব মিলে এক লীগময় পরিবেশ চারদিকে বিরাজ করছে, লীগ ক্ষমতায় না থাকার পরও। প্রশাসন বিশেষ করে আমলাতন্ত্র ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়।

অন্যদিকে, এখানে যারা পতঙ্গের পালের মতো বিএনপির বুদ্ধিজীবী হতে শুরু করেছে তারা নতুন উৎপাত হিসাবে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে একদল ধান্ধাবাজ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বিএনপির সঙ্গে এসে খাতির জমাতে শুরু করে দেয়। তাদের ধারণা ছিল বিএনপি বুঝি ক্ষমতায় আসবে। পরে রাতের ভোটে মাত্র ৭ সিট দেওয়া হলে তাদের আশাভঙ্গ হয়। তারা আবার দুই তাল রক্ষা করে চলতে থাকে। অভ্যুত্থানের পর দেখা যাচ্ছে-এত বছর যারা মুজিবের মূত্র সেবনকেও সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করত, তারা এখন জিয়া বা বিএনপি বন্দনায় মেতেছে। এটাই সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়। এরা যে অপরিচিত বা এদের লীগের গোলামি যে মানুষ জানে না, তা নয়। কিন্তু এরা এ অভ্যুত্থানের পরও লীগের আলোকে বিএনপির শুভানুধ্যায়ী হিসাবে যে হাজির হয়েছে তার জন্য বিএনপির অতি গণতন্ত্রপনা দায়ী কি না-আমি জানি না অথবা সুযোগ সন্ধানীদের প্রতিরোধের কোনো ম্যাকানিজম দলটার নেই হয়তো। কিন্তু যারা দাঁত কেলায়ে হাজির হচ্ছে তারাই বা কেমন মানুষ?

এরাই হলো সেই অংশ, যারা যে কোনো সরকারকে দানবীয় শাসনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এরাই আত্ম-সম্মানহীন কিন্তু নিজেকে বিশিষ্ট লোক মনে করা অবর্জনা। এরাই সমাজের লিকুইডিটিকে বাড়িয়ে চলেছেন। এ আত্মহীন মানুষগুলা মূলত জিন্দালাশ। এরা যেই দলের সঙ্গেই ভিড়বে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরা শুধু রাজনৈতিক দল নয়। সমাজের নৈতিক বিকাশের শত্রু। এদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধের জন্য সমাজের এ ধরনের লিকুইডিটি বা যখন যেমন তেমন পাত্রে জায়গা নিয়ে নেওয়ার চরিত্রকে বর্জন করতে হবে। ঠেকাতে হবে এ লিকুইডিটির জোয়ার। অগ্রাধিকার দিতে হবে-যারা সরাসরি পজিশন নেন তাদের। হয়তো তাদের পজিশন আপনি পছন্দ করছেন না। বা করতে পারছেন না। তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু সব সময় সরকারি দল করা। সব সময় সুবিধার দিকে থাকাদের যে কোনো মূল্যে প্রতিহত না করতে পারলে সমাজে পজিশন নিয়ে টিকে থাকার মতো মানুষ কমে আসবে। স্রোতের বিপরীতে চলারা সম্মান পাবে না। পজিশনের ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য হবে। এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু সবাই ক্ষমতাপন্থি হওয়ার দৌড় শুরু করলে গোটা সমাজের যে লিকুইডিটি তৈরি হবে, তা আমাদের জাতীয় বিকাশের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না হয়ে তেলতান্ত্রিক সমাজ হবে। এটা বুঝতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সব সময় যে সবার বন্ধু হয় সে আসলে বন্ধু না। সবার বন্ধু কারও বন্ধু হয় না।

অভ্যুত্থানের পর একটি দেশকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মসম্মানওয়ালা নৈতিক গুণে সমৃদ্ধ মানুষদের দেশ গঠনে এগিয়ে আসা। এজন্য লিকুইড চরিত্রের লোকদের চিহ্নিত না করতে পারলে ছদ্দ বিপ্লবী সেজে এরা ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদের আবাদ ভূমি বানিয়ে ফেলবে বাংলাদেশকে।

এ প্রবণতা প্রতিরোধে কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা যেতে পারে :

এখন দলগুলোর (বিশেষ করে বিএনপির) প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো প্রচুর সুজনসখী বের হবে। এ সখীদের যদি দূরে রাখতে পারে তা হলে ভালো লোকগুলা এমনিতেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হবে। এ প্রক্রিয়ায় সঠিক লোক চেনার একটা তালিকা দিই। এটা ফলো করতে পারলে লিকুইডিটি এড়ানো যাবে আশা করি।

১. কাউকে মাথায় তুলে নাচার আগে ১৫ বছরের আমলনামা দেখে নেবেন (বিশেষ করে শাহবাগে কি পজিশন ছিল এটা সবচেয়ে জরুরি, পরে এটার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে নাকি কোনো কথা না বলে চুপে জাতির বিবেক সেজেছে এটা দেখতে হবে)।

২. গত ৫ আগস্ট, ২০২৪-এর পর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কতটা বেড়েছে। চলনে পরির্বতন এসেছে কি না-এটা দেখে গ্রহণ করতে হবে।

৩. অন্যের বিরুদ্ধে নিন্দা করে। নিজেকে বড় মনে করে, দরকার-অদরকারে মিথ্যা বলে, গ্রুপিং করে এমন লোক সমাজের শত্রু। দূরে রাখুন।

৪. চালাকিকে জ্ঞান মনে করে। এমন লোকদের সর্বদা দূরে রাখতে হয়। কেন না চালাকির দ্বারা মহৎ কোনো কিছু অর্জন করা যায় না।

মনে রাখতে হবে, লিকুইড চরিত্রের মানুষ সব সময় অপরচুনিস্ট হয়। এরা যখন বন্ধু হয় তখন আপনার ক্ষতির জন্য শত্রু দরকার নেই। এ লিকুইডদের জন্যই বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ এত শক্তিশালী হতে পরেছে। আর কে না জানে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলার আগের ফয়সালা হলো সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করতে পারা। আর এর এজেন্ট হয় লিকুইড চরিত্রের আত্মপ্রতারকরা। নৈতিক সমাজ গঠনের প্রথামিক প্রক্রিয়া হলো এ লিকুইডিটিকে প্রতিহত করা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম