Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ধূমকেতু : নজরুলের অগ্নিবীণা ও বিপ্লবের প্রতিধ্বনি

Icon

উম্মে সায়মা

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধূমকেতু : নজরুলের অগ্নিবীণা ও বিপ্লবের প্রতিধ্বনি

ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতবর্ষে যখন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি সচেতন হৃদয়ে লেলিহান শিখার মতো জ্বলছে, ঠিক তখনই বাংলার সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আকাশে এক জ্বলন্ত জ্যোতিষ্কের মতো আবির্ভাব ঘটেছিল ‘ধূমকেতু’র। এটি কেবল একটি অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল না, ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাতেগড়া বিপ্লবের এক অগ্নিমশাল। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ (১১ আগস্ট ১৯২২), ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বিপ্লবীরা খুঁজে পেয়েছিল তাদের নির্ভীক কণ্ঠস্বর, তাদের নিজস্ব মুখপত্র।

সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হতো ‘ধূমকেতু’। নজরুল ইসলাম নবযুগ ছাড়ার দু’বছর পরে বিপ্লবীদের মুখপত্র হিসাবে এ পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে। শুরুতে ফুলস্কেপ কাগজের চার পৃষ্ঠায় এবং পরে আট পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হতো। প্রথম পৃষ্ঠায় কাগজের ওপর দিকে সৌরমণ্ডলের ছবি, তাতে ধূমকেতু আঁকা। সবই কালো কালিতে ছাপা। প্রতি সংখ্যার দাম ছিল ১ আনা।

পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশই ছিল এক দ্রোহের ঘোষণা। প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল তার বিখ্যাত অনলবর্ষী কবিতা ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। এর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট-বিপ্লবের আগুনকে উসকে দেওয়া, ঘুমন্ত কৃষক-মজুর ও মধ্যবিত্ত সমাজকে জাগিয়ে তোলা এবং পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে দ্বিধাহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করা। পত্রিকাটির শিরোভাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাণী-‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’-এর আদর্শ ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্ব এবং ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের উষ্ণ অভিনন্দন প্রমাণ করে, ধূমকেতুর আগমন ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি।

নজরুলের অগ্নিঝরা ভাষা ও আপসহীন সম্পাদকীয় নীতি পত্রিকাটিকে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বিক্রয়ের নিরিখে এটি তৎকালীন সব পত্রিকাকে ছাড়িয়ে যায়, যা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষ এক ধরনের নির্ভীক দিকনির্দেশনার জন্য কতটা তৃষ্ণার্ত ছিল। ধূমকেতু কেবল রাজনৈতিক ইশতেহার প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যার মাধ্যমে এটি তার সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক গভীরতার পরিচয় দেয়। এর মধ্যে ‘মোহররম সংখ্যা’টি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ছবি ছেপে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সরাসরি প্রতিবাদ দেখানো হয়।

তবে যে সংখ্যাটি ধূমকেতুর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে, তা হলো ‘আগমনী সংখ্যা’। এতে প্রকাশিত নজরুলের কালজয়ী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?’-এ পঙক্তিতে কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিল না, ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার উদাত্ত আহ্বান। ফলস্বরূপ, ব্রিটিশ সরকার পত্রিকার এ সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ১২৪ (ক) ও ১৫৩ (ক) ধারায় স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করে। তার বিচারের ভার পড়ল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর ওপরে, যিনি একজন কবিও বটে। নজরুল বিচারপতিকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তা ধূমকেতু’র শেষ সংখ্যায় ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। নজরুল লিখেছিলেন, ‘আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সেই বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্যস্বরূপ।’ এ ঘটনাই ধূমকেতুর নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়।

তার গ্রেফতারের পর ২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘নজরুল সংখ্যা’, যা ছিল সম্পাদকের প্রতি একযোগে শ্রদ্ধা ও প্রতিবাদের প্রতীক। এরপর বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলালের সম্পাদনায় কিছুদিন টিকে থাকার চেষ্টা করলেও সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে ধূমকেতুর তেজ ক্রমেই ম্লান হয়ে আসে। অবশেষে, ১৯২৩ সালের মার্চে বাংলার আকাশে ধূমকেতুর মতোই আবির্ভূত হওয়া এ অগ্নিশিখা চিরতরে নিভে যায়।

ধূমকেতুর জীবনকাল ছিল মাত্র সাত মাস। কিন্তু এ স্বল্প সময়ে ধূমকেতু যে রাজনৈতিক চেতনার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল, তা পরবর্তী স্বাধীনতাসংগ্রামে দাবানলের রূপ নেয়। এটি ছিল একটি পত্রিকা, একটি আন্দোলন এবং নজরুলের বিদ্রোহী আত্মার এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি, যা আজও বাংলা সাংবাদিকতা ও বিপ্লবের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম