Logo
Logo
×

বাজেট

সিপিডির বাজেট বিশ্লেষণ

রাজস্ব পদক্ষেপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১০:১৭ পিএম

রাজস্ব পদক্ষেপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক

প্রস্তাবিত ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। 

এবারের বাজেটের থিম ‘ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠন।’ কিন্তু এর সঙ্গে রাজস্ব খাতের কিছু পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক। সামগ্রিকভাবে এই বাজেট অনুমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে প্রত্যাশার বিপরীতে হতাশাজনক। করের ন্যায্যতার ঘাটতি আছে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ, জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। 

মঙ্গলবার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়। 

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংস্থাটি বলছে, এই বাজেট দেশের জনগণ ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশিত সমাধান দিতে পারত। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। সব ধরনের ব্যবসার ওপর ১ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ নয়। ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও বাড়িভাড়া খাতে উৎসে কর বাড়ানো হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে। বাজেটে বেশ কয়েকটি দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আয়-ব্যয়ের পার্থক্য, কর আদায়ের দুর্বলতা, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং মানব উন্নয়ন খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগ আগের মতোই আছে। এই বিভাগকে এখন পর্যন্ত পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। এবারের বাজেটে সরকার রাজস্ব বিভাগের কাছে এক রকমের আত্মসমর্পণ করেছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আয়ে বড় দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ৭ শতাংশের মতো। কিন্তু এশিয়াতে এই হার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। নেপালে ২২ শতাংশ। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত রাজস্ব আয় না বাড়ানো যাবে, ততক্ষণ বৈষম্য কমবে না। ব্যয়ও বাড়বে না। 

তিনি আরও বলেন, এবারও রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা উচ্চাভিলাষী। কারণ চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বাস্তবে সেখানে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকার কথা। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার মানে হলো চলতি বছরের প্রকৃত আয়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন। এটি একেবারেই সম্ভব নয়। তার মতে, প্রস্তাবিত বাজেট অনুমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে হতাশাজনক।  

মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট আকারের দিক থেকে ব্যতিক্রমী। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ছোট। এই বাজেটে প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর এবং ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এসব উদ্দেশ্যের পেছনে বাজেটীয় ব্যবস্থা বা পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে করছাড়, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ, প্রণোদনা এবং ক্ষতিকর কার্যকলাপের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, বাজেট চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এ খাতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে পারলে সাধারণ জনগণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বাস্তবিক স্বস্তি আনতে পারত। এতে আরও বলা হয়, বাজেটের থিম ‘একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠন। কিন্তু এর সঙ্গে কিছু রাজস্ব ব্যবস্থা সাংঘর্ষিক। মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, সিপিডি আশা করে অর্থ উপদেষ্টা বাজেটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব, বিশেষ করে অঘোষিত আয় বৈধ করার মতো বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করবেন। এই কঠিন সময়ে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। 

ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে আবাসন খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ফলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য প্লট বা ফ্ল্যাট কেনা অসম্ভব হয়ে যাবে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য হবে। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলন বৈষম্যহীন সমাজের জন্য হয়েছিল। বাজেটের প্রত্যয়টা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। তার সঙ্গে এই প্রস্তাব চরমভাবে সাংঘর্ষিক। 

ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে গেলে সেখানে অপ্রদর্শিত আয় দেখিয়ে বর্ধিত হারে বিশেষ কর দিয়ে সেটি ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু আমরা সব সময় বলে এসেছি কালোটাকা সাদা করার প্রস্তাব একেবারেই বন্ধ করা উচিত। এটা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা এটা সমর্থন করছি না। তিনি বলেন, এই প্রস্তাব সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে। তাদের নৈতিকতার ওপর আঘাত। আমরা এই প্রস্তাব উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করছি। এটা বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ার। উদাহরণ দিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আবাসন খাতের মূল্য অনেক বেশি। এর কারণ এই অপ্রদর্শিত অর্থ। এই অর্থ সেই খাতে সেটার দাম বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে যারা বৈধভাবে আয় করে তাদের জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য হয়। 

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, নতুন অর্থবছরের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাজেটকে প্রবৃদ্ধিমুখী ও ভৌত কাঠামোগত উন্নতির দিকে না নিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও জনবান্ধব করা। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা যে বাজেট উত্থাপন করেছেন, তার সঙ্গে বাজেটের প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটেনি। 

তিনি বলেন, করমুক্ত আয়সীমা ‘৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু এই আয়সীমা কার্যকর হবে ২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছর থেকে। সেই সময়ের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করলে কর আদায়ে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা নিতান্ত নগণ্য।’ অন্যান্য বাজেটের মতো এবারের বাজেটেও করের বড় চাপ পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। বিশেষ করে যাদের বার্ষিক আয় ৬ লাখ থেকে ১৬ লাখের মধ্যে তাদের গুনতে হবে বড় করহার। অন্যদিকে যাদের আয় ৩০ লাখের ওপরে, তাদের ওপর করের চাপ অপেক্ষাকৃত কম পড়বে। ফলে এ পদক্ষেপ পরিষ্কার বৈষম্য। এছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কারণ বিগত মাসের মূল্যস্ফীতির হার দেখে মনে হচ্ছে এই মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। এটি সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। 

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, এবার ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও বাড়িভাড়া খাতে উৎসে কর বাড়ানো হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে। এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সরকারি সংস্থা বিবিএস বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এখানে আগামী অর্থবছরে দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে, এই প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। নতুন বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২০টি মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট এডিপির ১৯ শতাংশ। অথচ কোনো প্রকল্পই চলতি অর্থবছরে শেষ হবে না। অনেক প্রকল্পের বয়স ১০ বছরের বেশি। ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রকল্প একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির ২ শতাংশের কম। এলডিসিভুক্ত (স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা) দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৩ শতাংশ। সিপিডি মনে করে, মানব উন্নয়নে এ দুটি খাতে আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর ব্যবধান ৭ দশমিক ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। যা বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে পারে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম