মরে গেলেও নির্বাচন বর্জন করব না: ড. কামাল
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসিতে ড. কামাল হোসেন। ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ নেই- এমন মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও অনুরোধ করেন তিনি।
সোমবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠকের পর ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, এখন যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলছে। এটা দ্রুত বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মরে গেলেও নির্বাচন বর্জন করব না। নির্বাচন হতে হবে।
ওই বৈঠকে সিইসিসহ অন্য কমিশনার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, গত আট দিনে ৯৫টি মামলায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২ হাজার ২৪১ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। চিঠিতে ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের ৩২ জন প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় বিচার ও কারাগারে আটক ১৪ প্রার্থীকে মুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। এছাড়া উচ্চ আদালতের রায়ে ধানের শীষের ছয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের আদেশে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের প্রার্থিতা বহাল রাখতে নির্বাচন কমিশনের জোরালো ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া সাদা পোশাকে পুলিশের তৎপরতা ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য বিতর্কিত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার বা বদলির দাবি জানানো হয়।
এ বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ড. কামাল হোসেন। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই- সরকার যদি তাদের বুদ্ধি খাটিয়ে মনে করে তারা (সরকার) এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যাতে আমরা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) নির্বাচন বর্জন করি, এটা তারা পারবে না। মরে গেলেও নির্বাচন বর্জন করব না। আমার লাশকে ইলেকশন কমিশন ভোট দিতে নিয়ে যাবে। আমার যে আঙুল থাকবে তা দিয়ে টিপ (ভোট) দেবে। ইলেকশন হতেই হবে।
এ নির্বাচন ঘিরে দেশে এমন পরিস্থিতি চলছে যা দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেখেননি বলে মন্তব্য করেন ড. কামাল হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম, ড. মঈন খান, মির্জা আব্বাসের ওপর হামলাসহ উত্তর ও দক্ষিণে সব জায়গা থেকে একইরকম হামলার খবর আসছে। পেশিশক্তি নিয়ে প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। যারা প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে তাদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে; যারা নির্বাচন করতে এগিয়ে এসেছে তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা খুব ভয়াবহ। আমরা ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ভালো-মন্দ সবই দেখেছি কিন্তু এমন পরিস্থিতি কোনোদিন দেখিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলাম। তখন থেকে এ পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি দেখিনি।
নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসিকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে আমাদের নেতাদের ওপর পুরো দেশে হামলার ঘটনাগুলো বলেছি। আমরা লিখিতভাবে হামলার স্থান, সময় ও ঘটনা উল্লেখ করে এসব তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছি। আসম আবদুর রবের ওপর হামলায় ভাঙা গাড়ির ছবিও দিয়েছি। আমরা সবকিছু প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি কেএম নুরুল হুদা) জানিয়েছি। তিনি কিছু কিছু বিষয়ে বিব্রতবোধ করেছেন। আমরা বলেছি, তার (সিইসি) এই বিব্রতবোধ করা যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ব্যাপারে এখনই তদন্ত করান, একদিনের মধ্যে রিপোর্ট চান। কিছু পদক্ষেপ নেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে নির্বাচন কমিশন এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে সমাজকে, দেশকে মুক্ত করতে চায়। যাতে নির্বাচনের ন্যূনতম একটা পরিবেশ আমরা পাই।
সংবিধান অনুযায়ী ইসির ক্ষমতা তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্বাচন শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সংবিধান ক্ষমতা দিয়েছে। এ সময় সরকার রুটিন কাজ ছাড়া কিছু করতে পারে না। নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষা করার মূূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর আঘাত, আক্রমণ যা ঘটছে তা দ্রুত বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
ঢাকায় একপাক্ষিক প্রচার চলছে জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ঢাকা শহরে একটি দলের প্রার্থীদের পোস্টার ছাড়া অন্য দলের পোস্টার দেখা যাচ্ছে না। আমার জীবনে এমন অবস্থা দেখিনি। আমি যতদিন বেঁচে আছি, যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন এসব কথা মানুষের সামনে বলব, প্রতিকার দাবি করব। জনগণের যে ভোটাধিকার, সরকার নির্বাচিত করার যে ক্ষমতা, লাখো লাখো শহীদ যে ক্ষমতা দিয়ে গেছে সেটা থেকে জনগণ যেন বঞ্চিত না হয়। এখন যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, এটা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এসব বন্ধের আদেশ দিতে পারে। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ইসি কেন ক্ষমতা প্রয়োগ করছে না তা তাদের জিজ্ঞাসা করুন। দুই দিনের মধ্যে দেখতে চাই অ্যাকশন হচ্ছে। না হলে আমাদের প্রতিদিন বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে ঐক্যফ্রন্টের জোটভুক্ত প্রার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নানাবিধ অপতৎপরতার প্রতিকার চেয়ে লিখিত চিঠিতে বলা হয়, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি হামলা ও গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় হামলা ও আক্রমণ চালানো হচ্ছে। চিঠিতে কয়েকটি হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- মিরপুর স্মৃতিসৌধে ড. তামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিবের ওপর, চট্টগ্রামে কর্নেল অলি আহমদ, নরসিংদীতে ড. আবদুল মঈন খানের নির্বাচনী প্রচারণায়, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নির্বাচনী প্রচারে, নোয়াখালীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও জয়নাল আবদিন ফারুকের ওপর, সিরাজগঞ্জে রুমানা মাহমুদের ওপর, ঢাকার সদরঘাটে ও ভোলায় মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের ওপর এবং কক্সবাজারে হাসিনা আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা ও হামলা। এছাড়া নেত্রকোনায় তাহমিনা জামানের নির্বাচনী সভা শেষে ফেরার পথে পুলিশি বাধা, বরিশালে জহিরউদ্দিন স্বপনের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, যশোরে অনিন্দ ইসলামের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, হামলা ও বোমা বিস্ফোরণ, পটুয়াখালীতে গোলাম মাওলা রনির স্ত্রী ও আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ওপর হামলা, মুন্সীগঞ্জে মিজানুর রহমান ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন পথসভায় হামলা ও মিথ্যা মামলা দায়ের, পাবনায় অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদের গাড়িবহরে হামলা, চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদের ওপর গণসংযোগকালে হামলা, কচুয়া উপজেলায় বিএনপি প্রার্থী মোশাররফ হোসেনের গাড়িবহরে হামলা, ফরিদগঞ্জে বিএনপি প্রার্থী জান্নান, রামগঞ্জে জোটপ্রার্থী শাহাদাত হোসেন সেলিম, নেত্রকোনায় রফিক হেলালী, ঝলকাঠিতে জিবা খান, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে আজহারুল ইসলাম মান্নান, ২ আসনে নজরুল ইসলাম আজাদ এবং সাতক্ষীরায় হাবিবুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তফসিল ঘোষণার আগে এবং তফসিল ঘোষণার পর এ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের ১৪ জন প্রার্থীকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলায় কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। কারাবন্দি প্রার্থীরা কয়েকটি মামলায় জামিনপ্রাপ্ত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে মুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
চিঠিতে ধানের শীষের ৬ প্রার্থীর প্রার্থিতা উচ্চ আদালতে স্থগিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১৪(৫) অনুচ্ছেদের বিধানমতে আপিলে বৈধতা বা অবৈধতা সংক্রান্ত কমিশনের আদেশই চূড়ান্ত বলে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১২৫(সি) অনুচ্ছেদের বিধানে ইসিকে নোটিশ না দিয়ে কিংবা শুনানির সুযোগ না দিয়ে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আদালতের এখতিয়ারকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে কমিশনের পক্ষে জোরালো ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।
৩১ জেলায় হামলার অভিযোগ ইসিতে : দেশের ৩১টি জেলার বিভিন্ন আসনে হামলার তথ্য জানিয়ে এক চিঠিতে বিনা কারণে গ্রেফতার, হয়রানি ও আওয়ামী লীগের হামলার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে জরুরি ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান বিএনপি মহাসচিব।
আট পৃষ্ঠার চিঠিতে হয়রানির চিত্র যেসব জেলায় ঘটছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- ঢাকা মহানগর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, জামালপুর, ঝিনাইদহ, ভোলা, চট্টগ্রাম, শেরপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, যশোর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ, নরসিংদী, নাটোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জয়পুরহাট, মেহেরপুর, রংপুর, পাবনা, কিশোরগঞ্জ, সাতক্ষীরা, ফেনী, সিরাজগঞ্জ ও হবিগঞ্জ।
