জাবির ‘টর্চার সেলে’ই বসবাস নবীন শিক্ষার্থীদের
রাহুল এম ইউসুফ, জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৫:২৯ পিএম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শতভাগ আবাসিকের তকমা লাগানো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীরা বসবাস করে গণরুম নামধারী ‘টর্চার সেলে’। আগে গেস্টরুমে ডেকে র্যাগিং বা টর্চার করা হলেও এখন করা হয় গণরুমে।
হলভেদে গণরুমে থাকতে হয় ২৫ থেকে ১৫০ শিক্ষার্থীর। ম্যানার (আচার-আচারণ) শেখানোর নামে গভীর রাতে এ সব শিক্ষার্থীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীরা।
নির্যাতনের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়া, কান ফাটা, শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে গণরুমকে টর্চার সেল বলতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শাখা ছাত্রলীগ। তাদের দাবি- বর্তমানে র্যাগিং কমেছে।
গত পাঁচ বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে হল ছেড়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ও ছেড়েছেন। আবার ছেলেদের হলে গণরুমে থাকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মেয়েদের হলে নির্যাতনের মাত্রা কম। তবে নবীনদের নির্যাতনের দায়ে আজীবন বহিষ্কারের কালিমাও লেগেছে মেয়েদের গায়ে।
ছেলেদের হলগুলোতে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় সিট বণ্টনের দায়িত্ব থাকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর। ফলে সিটের জন্য নবীন শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নির্যাতন সহ্য করে। নির্যাতনের মাত্রা বেশি হলে প্রশাসন নেয় তদন্তের ভার। দু'একটি ঘটনায় শাস্তি হলেও অধিকাংশ ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয় ‘খোঁড়া’ অজুহাতে।
নবীনদের নির্যাতন ছাড়াও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা, নিজ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হলছাড়া করা, ছিনতাই, শিক্ষক ও ছাত্রী লাঞ্ছনা, ক্যাম্পাসের ভেতর ও বাইরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, তুচ্ছ ঘটনায় অস্ত্রের মহড়া এবং ভর্তি পরীক্ষায় বাঁধা সৃষ্টি করার মতো মারাত্মক অভিযোগ।
জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের ৮টি করে আবাসিক হল রয়েছে। নবীন শিক্ষার্থী হলে উঠলে প্রত্যেক হল তাদের জন্য হয়ে ওঠে একেকটি ‘টর্চার সেল’। তবে মেয়েদের হলগুলোতে র্যাগিং বা টর্চার কম হলেও মাত্রাতিরিক্ত রয়েছে ছেলেদের হলগুলোতে।
এর মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে টর্চারের ঘটনা বেশি ঘটে।
মীর মশাররফ হোসেন হলের আলোচিত ঘটনাগুলো মধ্যে এ বছরের ২৫ মার্চ সরকার ও রজানীতি বিভাগের রাজন মিয়াকে গণরুমে থাপ্পড় মেরে কানের পর্দা ফাটায় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের রাকিব হাসান সুমন ও একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন বিভাগের সাকিব জামান।
এর আগে রসায়ন বিভাগের শরিফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ২০১৬ সালে রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষের নবীন ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতন করে।
এ ছাড়া এ হলের গণরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সবচেয়ে আপত্তিকর গালি ও অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়, যা নবীন শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক যন্ত্রণা বাড়ায় বলে জানিয়েছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে রয়েছে সবচেয়ে বড় গণরুম। এক রুমেই থাকে ১৫০ থেকে ২০০ জন নবীন শিক্ষার্থী। এ রুমে সিটিংয়ের নামে র্যাগিং দেয়া হয়। এ বছরের জুলাইয়ে গণিত বিভাগের ফয়সাল আলমকে থাপ্পড় দিয়ে কান ফাটায় মার্কেটিং বিভাগের শিহাব।
এ ছাড়া গণরুমে সবাইকে র্যাগিংয়ের হুমকি দেয়ায় নবীন শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে এক রাত খোলা আকাশের নিচে কাটায়। এ হলের ৩৪৮ নং রুমকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার হয়েছে দীর্ঘদিন।
ছাত্রলীগ নেতা সৌরভ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যাকে ইচ্ছা ধরে এনে শারীরিক নির্যাতন করত। চলতি বছরের ৭ মে শাখা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম সম্পাদক কৌশিক রহমান শিমুলকে মোবাইল ‘চোর’ তকমা দিয়ে মারধর করে হল থেকে বের করে একই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
এ ছাড়া হলের ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ ঘটনায় জুনিয়রদের ব্যবহার করে সংঘর্ষে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
এ বছর ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী হলের ১১৪নং রুমে মোশাররফ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থীকে মেরে কানের পার্দা ফাটিয়ে হাসপাতালে পাঠায় বাংলা বিভাগের জাহিদ হাসান তুহিন ও মো. নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া এ হলের ছাত্রলীগ নেতাকে নিজের মোটরসাইকেলের চাবি না দেয়ায় এক ছাত্রকে বেধড়ক মারধর করে ৬ ছাত্রলীগ কর্মী।
এ হলে নবীন শিক্ষার্থীদের ৪ জনের রুমে ২০-২৫ জন করে রাখা হয়। নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেন কেউ দেখা করতে না পারে এ জন্য রাতে ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীরা গণরুম পাহারা দেয়।
২০১৮-১৯ সেশনের রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের অনুমতি না নিয়ে এক সিনিয়রের রুমে গেলে ওই বিভাগের সব জুনিয়রকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ ছাড়া এ হলের ১১৪নং রুমকে বিচারালয় (টর্চার সেল) হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
গত বছর শহীদ সালাম-বরকত হলের র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মিজানুর রহমান। এর আগের বছর সরকার ও রজনীতি বিভাগের রাশেদুল ইসলাম আদেশসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গত তিন বছর এ হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজের মধ্যে অন্তত চারবার মারামারি করেছে।
এ ছাড়া আ ফ ম কামালউদ্দিন হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল এবং আল-বেরুনী হল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রয়েছে একই অভিযোগ। আল বেরুনী হল ও রফিক-জব্বার হলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের মমতাজ বেগম অন্তরাকে র্যাগিংয়ের অভিযোগে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে বিভাগটির দ্বিতীয় বর্ষের সাবরিনা আক্তার মিতু, রাজিয়া ও সামি রেজওয়ানা নামের তিনি ছাত্রীকে আজীবন বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনার পর মেয়েদের হলগুলোতে র্যাগিংয়ের তীব্রতা কমতে শুরু করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণরুম সংস্কৃতি একজন নবীন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিসরকে সংকুচিত করে। তারা নানা প্রতিকূল পরিবেশে পড়ালেখার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত ও নির্যাতিত হয়ে তারা মাদক নেয়া শুরু করে।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা জাবির গেস্টরুম সংস্কৃতিকেই টর্চার সেল বলে উল্লেখ করেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর খবরদারি করতেই ছাত্রলীগ হলে হলে টর্চার সেল তৈরি করেছে। প্রশাসনের উদাসীনতায় ও দায়িত্ব অবহেলায় এ ক্ষমতা পেয়েছে ছাত্রলীগ। তারা ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টি এমনকি ভর্তি পরীক্ষায় বাঁধা দিয়েছে, কিন্তু প্রশাসন কোনো বিচার করতে পারেনি।’
এই টর্চার সেলের নির্যাতনের ফলে অনেকেই ক্যাম্পাস ছেড়েছে এবং এই কারণেই ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রে কর্মরত মনোবিজ্ঞানী ইফরাত জাহান যুগান্তরকে বলেন, ‘গণরুমে একসঙ্গে অনেক মানুষ, অগোছাল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ফলে অনেকের মধ্যে মেন্টাল ডিজঅর্ডার তৈরি হয়। এর ফলে মানসিক যন্ত্রণা বেড়ে যায়। আর অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষার গালি শুনার পরে অনেকে মানসিক অবস্থায় ভেঙে পড়ে। যারা পারিবারিকভাবে ভার্নারেবল (ভঙ্গুর) তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এর প্রভাব দীর্ঘদিন থাকে। ফলে অনেকে হতাশা, ক্ষোভ, আর প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অবার গণরুম সংস্কৃতি অনেকে ‘এনজাইটি ডিজঅর্ডার’-এ আক্রান্ত হয়। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। ফলে অনেকে পড়ালেখা শেষ করতে পারে না।’
এ সময় তিনি তার কাছে কাউন্সিলিংয়ে আসা ক্যাম্পাসের একাধিক শিক্ষার্থীদের ওপর গণরুমের প্রভাবের উদাহরণ দেন।
এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক যুগান্তরকে বলেন, ‘জাবির গণরুম একটি শারীরিক ও মানসিক টর্চার সেল। হতাশার বিষয়ে এই যে, টর্চার কমাতে এবং নবীন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে প্রশাসন লোক দেখানো কর্মসূচি ছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘জাবিতে টর্চার সেল বলতে কিছু নেই। গণরুম আছে। সেখানে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। সেটাকে ঢালাওভাবে ছাত্রলীগের দোষ দেয়া যাবে না। ছাত্রলীগের পদধারী কেউ গণরুমে যায় না। কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র এ সব কাণ্ড ঘটায়। ছাত্রলীগ র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের ঘটনাও কমেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, র্যাগিং দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি। তাই এটি নির্মূল করতে আমাদের একটু সময় লেগেছে। এখন র্যাগিং নেই বললেই চলে। এ বছর আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। হলে হলে শিক্ষকরা তদারকি করছেন। আশা করি, এ বছরই ক্যাম্পাস থেকে র্যাগিং নির্মূল হবে।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের মন্তব্য জানতে তার মোবাইলে কল দেয়া হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
