ঢাবির চারুকলায় ভর্তিযুদ্ধে প্রথম
জীবনে রঙ থাকলে প্রাণবন্ত লাগে: কাবেরী (ভিডিও)
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২১, ১১:৪৭ এএম
কাবেরী আজাদ।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কাবেরী আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) যার নাম জয়-জয়কার। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের চারুকলা অনুষদ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। প্রায় ১৬ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ ১১০ দশমিক ২৫ নম্বর পেয়েছেন।
কাবেরীর সাজগোজে আড়ম্বর নেই, প্রাণের পরশ আছে। ভাবনা আছে। যখন কথা বলেন, খুব ভেবেচিন্তে বলেন। মেধাবী কাবেরীর কণ্ঠেও রয়েছে যত্নের ছোঁয়া। কাবেরীর রঙের প্রতি খুব টান। ছোট্ট এ জীবনাচারে রঙের গল্পই বেশি। জীবনজুড়েই যেন আঁকা-আঁকি। শিক্ষা জীবনের গল্প-স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে...
ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা কাবেরী আজাদ এখন ঢাকায়। ঢাবির আনাচে-কানাচ ঘুরে দেখছেন। চারুকলা অনুষদের স্থাপনা-সবুজ ঘেরা চারপাশ বিগত দুই বছর আগ থেকেই ভালোবেসে ফেলেন। ভর্তি পরীক্ষার আগেই যা ভেবেছেন-সেই ভাবনাটাই সত্যি হলো।
তার ভাষ্য ‘পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি-সেটি জানতাম, বিশ্বাস এবং প্রাণশক্তিও ছিল। রঙ আমার জীবন ঘিরেই থাকে-রয়েছে। রঙের টানটা এমন যে, আমি প্রায়ই রঙ খেয়ে ফেলতাম। রঙের প্যালেট যেন আমার একান্ত সঙ্গী।'
কাবেরীর মা-বাবা এখন গাইবান্ধা সদরে থাকেন। গ্রামের বাড়ি ছিল পাবনা বেড়া উপজেলায়। কাবেরী পঞ্চম, ষষ্ঠ, এসএসসি এবং এইচএইসিতে বৃত্তি নিয়ে পাশ করেছেন। তার ছোট এক বোন এবং ভাই রয়েছে। দুজনই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী।
তার মা শেফালী খাতুন, রত্নগর্ভা মা হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন; পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারও। আর বাবা, এক কথায়-সন্তানের জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছেন। মাথায় শুধু সন্তানদের পড়াশোনা।
কাবেরীর ভাষায়, মা-বাবাই তাদের আর্দশ। গ্রামে থাকতেন, মা-বাবার চেষ্টা, আমরা যেন ভালো থাকি। পড়াশোনায় সর্বোচ্চ সহযোহিতা করেন। সেই কাজটি করতে গিয়ে নিজেদের প্রতিও তারা খুব একটা খেয়াল রাখতে পারেননি। আমাদের সুস্থ থাকাই যেন তাদের সুস্থতা।
মা প্রায়ই বলেন, ‘আমি যখন একেবারেই ছোট্ট- মা তখন আমার পায়ে রশি-ওড়না দিয়ে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। বাড়ির চারপাশে পানি ছিল-যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়। পানিতে পড়ে না যাই। নিরাপত্তার জন্যই এমনটা করতেন।'
বাবা-মায়ের আগ্রহের কারণেই ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে পড়া-এমনটা জানিয়ে কাবেরী বললেন, ‘ক্যাডেট কলেজের কথা শোনেই ভাবতাম, বন্দি জীবন-ঘুরাফেরা যাবে না। কিন্তু মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসি। মা-বাবা শিক্ষিক মানুষ। মায়ের ইচ্ছেও ছিল ক্যাডেট কলেজে পড়ার। এসব ভেবেই ভর্তি হলাম ক্যাডেট কলেজে।
বিভিন্ন সময়, মা-বাবা গাইবান্ধা থেকে রান্না করে খাবার নিয়ে আসতেন। আমি যখন খাবার খেতাম-ওই সময় মা-বাবার চোখের জল গাল বেয়ে গড়াতো। কেন? আনন্দে, তাঁরা মনে করে আমি কি খাই-কি খাই না। মায়ের হাতের রান্নার কী তুলনা হয়? তবে ক্যাডেট কলেজে নিজেকে আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি। সেই আবিষ্কারে রঙটাই ছিল ভাবনাজুড়ে।
কাবেরী বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। জানালেন, বিজ্ঞান থেকে পড়াশোনা শেষ করে শত মানুষের মতো হয়তো বড় বড় চাকরি করতে পারতাম। অফিসার বনে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি কি আঁকা-আঁকিতে থাকতে পারতাম? থাকা সম্ভব ছিল না। তাই আঁকা-আঁকিকেই ভালোবাসলাম। তবে আমি বলতে চাই, নিজের ভালোলাগা-পড়াশোনার বিষয়ে অভিভাবকেরও সম্মতি থাকা উচিত।
আবার সন্তানের ভালোলাগাকেও বাধা দেওয়া যথাযথ নয়। আমার মা-বাবা অনেক খুশি, আমি যা চেয়েছি-তা হয়েছি বলে। সন্তানদেরও খেয়াল রাখতে হবে-নিজের ইচ্ছেটুকু যথাযথ কী না। কারণ মা-বাবার সাপোর্ট মানেই এক দারুণ আশীর্বাদ।'
তখন দুপুর আড়াইটা। ঢাবি এলাকায় দাঁড়িয়ে কাবেরী বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। প্রথম দিয়ে জ্ঞান মাপা যায় না। জ্ঞান মাপার কোনো গজ-ফিতা থাকে না। আমি এঁকে যেতে চাই, আঁকতেই চাই। আঁকা আমায় যেখানে নিয়ে যেতে চায়-যাক। আমি অনেক বড় হব-এমন চিন্তা আমায় টানে না। তবে মানুষকে ভালো মানুষ হতে হয়। নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়তে হয়।
বাবা মো. আবুল কালাম আজাদ বললেন, আমার সন্তানরাই আমার সম্পদ-ভবিষ্যৎ। কাবেরী বড়, তার ছোট এক বোন ও এক ভাই আছে। সবাই দারুণ মেধাবী। ওটাই আমার শক্তি। বাড়ি-গাড়িতে আমার লোভ নেই-সন্তানের ভালো ফলাফলে আমার বেশ লোভ। তারা মানুষ হিসেবেও অনেক ভালো। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ-স্বপ্ন আকাশসম। মেয়ের জীবন নিরাপদ হোক। নিরাপদ পৃথিবী আমাদেরকেই গড়তে হবে। যেখানে আমাদের সন্তান নিরাপদে থাকবে।
মা শেফালী খাতুনের আনন্দের যেন শেষ নেই। বললেন, ‘গ্রাম থেকে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ক্যাডেট কলেজে পড়ারও ইচ্ছা ছিল। বিয়ের পর শিক্ষকতা করার প্রস্তাব ছিল দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। করিনি শুধুমাত্র সন্তানের জন্য। তাদের পড়াশোনায় সর্বোচ্চ সময় দিচ্ছি। নিজে না পরে-না খেয়ে তাদের চাহিদা পূরণ করছি। আমার মেয়ে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, আমি আনন্দে-খুশিতে কেঁদেছি। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি- আমার কাবেরীর শিক্ষা জীবন যেন নিরাপদ হয়। মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।'
‘জীবনে রঙ থাকলে জীবনটা প্রাণবন্ত লাগে। একা থাকলেও একাকিত্ব টের পাওয়া যায় না’— বলছিলেন কাবেরী আজাদ।
