১৩৫ বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছে সেন্ট গ্রেগরি
মো. মোস্তাকিম আহমেদ, পুরান ঢাকা
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা এবার ১৩৫ বছরে পা রাখতে চলেছে। সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাংলাদেশের একটি ক্যাথলিক বিদ্যালয়। প্রধানত ইংরেজ ও অ্যাঙলো ইন্ডিয়ানদের জন্য ১৮৮২ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয়েছিল স্কুলটি। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন বেলজিয়াম থেকে আগত খ্রিষ্টান মিশনারি ফাদার গ্রেগরি দ্য গ্রুট। স্কুলটি শুরু হয়েছিল মাত্র ২ জন শিক্ষক নিয়ে। শুরুতে ছাত্র অনেক কম থাকলেও বর্তমানে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭৬০ জন এবং মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৩৩ জন।
বর্তমানে স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ব্রাদার প্লেসিট পিটার রিবেইরু। তিনি বলেন, একজন বাবা যেমন সন্তানকে নিজের চেয়েও বেশি জ্ঞানী হিসাবে দেখতে চান। ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সন্তানদের আমার সাধ্যমতো শিক্ষা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করি। আমাদের এ চেষ্টা আমরণ অব্যাহত থাকবে।’
উপাধ্যক্ষ ব্রাদার লিওনার্ড চন্দন রোজারিও সিএসসি বলেন, পাঁচ বছর ধরে এখানে কর্মরত আছি। প্রতিনিয়ত এখানে সফলতার ঝুড়ি ভারী হচ্ছে। স্কুলের ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের অসংখ্য বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব তৈরির প্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল। উপমহাদেশের অর্থনীতিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনও সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র ছিলেন। যিনি বিশ্বময় তার নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করাতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। শত ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে আসতে তিনি ভোলেননি। সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে উঠেও তিনি তাই ভুলতে পারেননি তার ছোটবেলার বিদ্যাপীঠকে। এমন অসংখ্য বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব তৈরির প্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, জাতিসংঘে এ দেশের সাবেক প্রতিনিধি অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য-এমন অসংখ্য ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে এ বিদ্যালয়।
জানা যায়, ১৮৯২ সালে খ্রিষ্টান মিশনারি ফাদার গ্রেগরি দ্য গ্রুটের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে এ বিদ্যালয়। তারপর যত দিন গেছে, ততই সাফল্যের পালক যুক্ত হয়েছে এর গায়ে। শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে ভবিষ্যতের শুভ উজ্জ্বল পথনির্দেশনা দিয়ে চলেছে এ বিদ্যালয়। এখনো অতীতের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি, যেটি বর্তমানে পরিচিত ‘সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল ও কলেজ’ নামে। সেন্ট গ্রেগরির প্রথম হেডমাস্টার ছিলেন ফাদার গ্রেগরি দ্য গ্রুট। তিনি ছয় বছর ছিলেন এই পদে। তারপর হেডমাস্টার হয়েছিলেন টফ.এ. বোয়েরেস (১৮৯৯-১৯১০)। মূলত তার সময় শিক্ষক সংখ্যা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ফাদার বোয়েরেসের সময় শিক্ষকতার কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন চারজন হলিক্রস সিস্টার ও জনৈক সি.ই. লাতশ। ফাদার বোয়েরেসের সময়ই সরকারি স্বীকৃতি পায় গ্রেগরি। তৎকালীন গ্রেগরিতে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের সুযোগ ছিল। প্রথমে যেই বাড়িটিতে স্কুলের অবস্থান ছিল ওই বাড়িটি বর্তমানে আর নেই। কেননা পরে এর আয়তন বৃদ্ধি করা হয়।
১৮৯২ সালে প্রথম গণনায় জানা যায়, তখনকার সময় স্কুলটির ছাত্রছাত্রী সংখ্যা যথাক্রমে ২৬ জন ও ১৬ জন ছিল। এরপর আবার ১৮৯৭ সালে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫ জন হয়।
সেন্ট গ্রেগরি যেহেতু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদেশিদের জন্য তাই মোট শিক্ষার্থীদের মাত্র শতকরা পনেরো ভাগই বাঙালি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারত। সেজন্য ১৮৯৮ সালে মাত্র ছয়জন ছাত্র ও দুজন ছাত্রী শিক্ষারত ছিল। পরে অর্থাৎ ১৯১২ সালে মেয়েদের জন্য আলাদা একটি বিভাগ চালু করা হয়, যা পরে সেন্ট জেভিয়ার স্কুল নামকরণ করা হয়। ১৯১৫ সালে লাতিন ভাষাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে স্কাউটসের প্রচলন শুরু হয় গ্রেগরি থেকেই। এছাড়া আমাদের দেশে বাস্কেটবল খেলার প্রচলনও শুরু করে গ্রেগরিই ১৯৪৭ সালে। দেশ বিভাগের সময় এখানে বাংলা মিডিয়ামের পড়া শুরু করা হয়। ঢাকা শিক্ষ বোর্ড কর্তৃক সেন্ট গ্রেগরি স্বীকৃতি পায় ১৯২৪ সালে। অতঃপর ১৯২৫ সালে এই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৮৫ জন হয়। যাদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ছিল। যেখানে ৪৯ জন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ২৭ জন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, ৪ জন মুসলমান ও ৩ জন ইহুদির সঙ্গে ছিল ২ জন পারসি।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পরে অর্থাৎ ২০০৮ সালে অবশ্য পুনরায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়া চালু করা হয়। যুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালে গ্রেগরিকে অনেক কঠোর সময়ের মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ এই স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্র, শিক্ষকসহ মোট ৩০ জনকে পাক হানাদার বাহিনী জগন্নাথ কলেজসংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় ও নির্মমভাবে হত্যা করে। এই দিন শিক্ষক পিডি কস্তাসহ একাধিক শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিবছর এই দিনটিতে তাই তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা অর্পণ করে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সেন্ট গ্রেগরির এখানেই ঢাকার নটর ডেম কলেজের জন্ম। পরে ১৯৫৩ সালে নটর ডেমকে স্থানান্তর করে মতিঝিলে নেওয়া হয়। তবে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে গ্রেগরি খ্যাতি অর্জন করে। এই খ্যাতির জের ধরেই মূলত ১৯২৮-১৯৭৩ পর্যন্ত ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মোট ১১ জন শিক্ষার্থী প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। প্রথম যিনি ম্যাট্রিকে ১ম হন তার নাম হেক্টর ড্যানিয়েল। এছাড়া আরেক নথিতে দেখা যায়, ১৯২৫-১৯৭৩ পর্যস্ত ২৪০৪ জন এবং এদের মধ্যে ২২৮৭ জন পাশ করে। এতে পাশের হার ছিল শতকরা ৯৫ ভাগ। গ্রেগরি স্কুল ২০১৬ সালে কলেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেবল একটি শিক্ষায়তন নয়, বরং একটি আদর্শ, একটি সংস্কৃতি এবং একটি ঐতিহ্য যা ১৩৫ বছর ধরে জ্ঞানের আলোকবর্তিকারূপে পথপ্রদর্শন করছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে না, বরং নৈতিক মূল্যবোধ, সুদৃঢ় শৃঙ্খলা এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশও ঘটায়। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজস্ব বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হয়েছেন ১২ জন। তাদের মধ্যেই একজন এখানকার খেলাধুলার শিক্ষক মো. সাকিব। মো. সাকিব জানান, এখানে সব ধরনের খেলাধুলাসহ বিতর্ক সংঘ, বিজ্ঞান সংঘ, গণিত সংঘ, ইংরেজি সংঘ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের বহুমুখী প্রতিভার উন্মেষ ঘটায়। স্কুলের সাংস্কৃতিক অঙ্গন শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যেখানে সংগীত, নৃত্য, নাটকসহ বিভিন্ন শিল্পকলার চর্চা হয়। আগামী মাসের ১৫ তারিখে আমরা ২০ জনের টিম নিয়ে জাপান যাব খেলাধুলার জন্য। অতীতেও ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে খেলাধুলার জন্য যাওয়া হয়েছে।
