Logo
Logo
×

শেষ পাতা

১৫১ বছরের ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য

নান্দনিক চেহারায় ফিরছে নর্থব্রুক হল

Icon

মো. মোস্তাকিম আহমেদ, পুরান ঢাকা

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নান্দনিক চেহারায় ফিরছে নর্থব্রুক হল

ছবি: যুগান্তর

নর্থব্রুক হল, যা লালকুঠি নামেও পরিচিত। এই সুদৃশ্য ভবন ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিপুণ নিদর্শন এটি। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকায় এলে তার সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৫১ বছর আগে নির্মিত ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের বাহক ভবনটি পরিচর্যার অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি সংস্কারের ফলে আবারও নান্দনিক চেহারায় ফিরছে ভবনটি।

শুরুর দিকে ভবনটি ছিল নগর মিলনায়তন। পরবর্তী সময়ে একে গণগ্রন্থাগারে রূপান্তর করে এর সঙ্গে জনসন হল নামে একটি ক্লাবঘর সংযুক্ত করা হয়। ভবনটির নির্মাণকলায় মোগল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সংমিশ্রণ ঘটেছে।

জানা যায়, ১৮৭৯ সালের শেষদিকে নর্থব্রুক হলের নির্মাণকাজ শেষ হয়। পরের বছরের ২৫ মে ভবনের উদ্বোধন করেন ঢাকার তৎকালীন কমিশনার। ওই সময় ঢাকার স্থানীয় ধনাঢ্যরা গভর্নর নর্থব্রুকের সম্মানে এ ভবনের নাম দেন ‘নর্থব্রুক হল’। শুধু তাই নয়, ভবনসংলগ্ন সড়কের নামকরণও করা হয় ‘নর্থব্রুক হল রোড’ নামে। এ ভবনেই আয়োজন করা হতো তৎকালীন পদস্থ রাজকর্মচারী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সভা এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। ১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এখানেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৮৮২ সালে এটিকে টাউন হল থেকে পাঠাগারে রূপান্তর করা হয়। ওই সময় ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা লাইব্রেরিতে অনেক বই উপহার দেন। ১৮৮৭ সালে ইংল্যান্ড থেকেও আনা হয় বেশকিছু বই। কয়েক বছরের মধ্যে পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে যায়।

এই পাঠাগারে মূল্যবান ও দুর্লভ বই ছাড়াও রাখা হতো বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। স্থানীয়রা এখানে এসে বই ও পত্রিকা পড়তেন। দুজন কেয়ারটেকার দিয়েই পরিচালিত হতো গ্রন্থাগারটি। বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে এ ভবনটি একসময় জমে উঠত আড্ডা আর আনন্দে। এটির জৌলুস ছিল প্রমত্তা বুড়িগঙ্গার মতোই। লাল রঙে রাঙানো থাকায় নর্থব্রুক হলের পরিবর্তে স্থানীয়রা একে লালকুঠি নামেই ডাকা শুরু করে।

পাকিস্তান আমলেই লালকুঠি তার ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে ভবনের লাইব্রেরিটি। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনদিন লালকুঠিও হারাতে বসে তার চাকচিক্য। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিণত হয় পোড়াবাড়িতে। ২০১৬ সালে ভবনটির ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, সংস্কারের ফলে আবারও পুরোনো রূপে ফিরছে লালকুঠি। আদি নকশা অনুযায়ী সাজানো হচ্ছে কাঠের দরজা-জানালা, ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে কারুকাজ। ভেতরে সেন্টার রিং করে ছাদ মেরামত করা হয়েছে। শ্রমিকরা জানান, দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে নতুন করে লালকুঠির সংস্কার করা হচ্ছে। যারা কাজ করছেন, তারা সাধারণত দেশের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোর সংস্কারকাজই করেন।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা শ্রমিকনেতা সুমন ভূইয়া স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমরা ছোটবেলায় পাল তোলা নৌকায় চড়ে দেখতাম আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি ও রূপলাল হাউজসহ নদীর দুই পাড়ের অপরূপ দৃশ্য। এখন আর তা দেখা যায় না। কারণ, সেখানে লঞ্চ টার্মিনাল হয়েছে। পাশাপাশি নানা অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তবে সরকার সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।

বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল যেন বুড়িগঙ্গা থেকেই দেখা যায়, সেজন্য হলের সামনের স্থাপনা সরিয়ে নিতে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওনারা একটা প্রতিবেদন জমা দেবেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকলে সেগুলো উচ্ছেদ করে জায়গাটা কীভাবে দৃষ্টিনন্দন করা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ও সংস্কৃতিচর্চার বিশাল কেন্দ্র ছিল লালকুঠি। এটিকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে এনে পর্যটন সম্ভাবনা তৈরির কাজ চলছে। পুরোনো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে লাল রঙের পাশাপাশি ভবনের ভেতরে লাইব্রেরি, ডিজিটাল আর্কাইভ, বুক ক্যাফে, লালকুঠির ঐতিহাসিক ছবি প্রদর্শনী গ্যালারিসহ আরও অনেক কিছু থাকবে। এর সামনের দিকে থাকবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব পালনের স্থান ও চা-কফি শপ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম