মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও সুন্নিদের দফায় দফায় সংঘর্ষ
রণক্ষেত্র হাটহাজারী
সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর, আহত দেড় শতাধিক * ১৪৪ ধারা জারি, সেনা উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ * ৩ শর্তে সমঝোতা
চট্টগ্রাম ব্যুরো ও হাটহাজারী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রোববার বিকালে হাটাহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী এবং জশনে জুলুসে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ধাওয়া-পালটাধাওয়া এবং বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপের ফলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে দুপক্ষের দেড়শতাধিক আহত হয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪। পালটাপালটি অভিযোগ এনে দুপক্ষ সংঘর্ষে জাড়ায়। হাটহাজারী মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘জুলুসে অংশগ্রহণকারীরা তাদের লক্ষ্য করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও অশালীন ভঙ্গি করেছে।’ আর জুলুসে অংশগ্রহণকারী সুন্নি আকিদার অনুসারীদের অভিযোগ, ‘কওমি মাদ্রাসা থেকে তাদের লক্ষ্য করে গরম পানি ছুড়ে মারা হয়েছে।’
জানা যায়, সুন্নি আকিদার অনুসারীরা বিভিন্ন উপজেলা থেকে গাড়িবহর নিয়ে জশনে জুলুসে যোগ দিতে চট্টগ্রাম শহরে যাচ্ছিলেন। এ সময় গাড়িতে থাকা এক যুবক হাটহাজারী দারুল উলুম নিয়ে আপত্তিকর কটূক্তি ও ‘অঙ্গভঙ্গি’ করে একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে বিকালে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কওমি লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। সন্ধ্যায় জুলুসের গাড়ি ফেরার পথে হাটহাজারী মাদ্রাসার কাছে বাস স্ট্যান্ড এলাকায় মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা জুলুসের গাড়িতে হামলা চালান। এতে অনেকে আহত হন। ঘটনাটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সুন্নি আকিদার লোকজন হাটহাজারী বাজার ও কাচারি সড়কে অবস্থান নেন। আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কওমি লোকজন মাদ্রাসার সামনে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের হাটহাজারী বাজার এলাকায় অবস্থান নেন। উভয়পক্ষ টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায় শুরু হয় ধাওয়া-পালটাধাওয়া। একপক্ষ আরেকপক্ষকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ভাঙচুর করা হয় যানবাহন। খবর পেয়ে উপজেলা কর্মকর্তা ও স্থানীয় থানার কর্মকর্তারা ছুটে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। ছুটে আসে সেনাবাহিনীর একটি টিমও। এরপর মাইকে দুপক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ও আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করেন; রোববার বেলা ৩টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল।
হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তাপস কান্তি মজুমদার জানান, সংঘর্ষে উভয়পক্ষের দেড়শতাধিক লোক আহত হয়ে হাসপাতালে আসেন। গুরুতর আহত ২০ জনকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া সুন্নি আকিদার আহত ১৫-২০ জন হাটহাজারী পৌরসভা এলাকায় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
রোববার বিকালে হাটাহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি খলিল আহমেদ কাসেমীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন মাওলানা মুনির আহমদ। তিনি বলেন, ‘হামলার ঘটনা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ওইদিন সুন্নি নামধারী বিদআতপন্থিরা হাটহাজারী মাদ্রাসার সামনে এসে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে খেপানোর চেষ্টা করে।’
অন্যদিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত হাটহাজারী শাখা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, ‘মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের দিনে তারা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এবং জশনে জুলুস উদযাপন করেন। চট্টগ্রাম শহরে অনুষ্ঠিত জুলুসে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগম ঘটে। শনিবার সকালে ফটিকছড়ি, হাটহাজারীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে গাড়ি নিয়ে জুলুসে যাওয়ার পথে মাদ্রাসার ভবন থেকে জুলুসের গাড়ি লক্ষ্য করে গরম পানি নিক্ষেপ করা হয়। আবার ফেরার সময় তারা দলবদ্ধ হয়ে জুলুসের গাড়ি আটকে ভাঙচুর শুরু করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।’
তিন শর্তে সমঝোতা : এদিকে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। রোববার সন্ধ্যা ৬টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন সমঝোতা বৈঠকের আয়োজক হাটাহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলা মিলনায়তনে বৈঠক শুরু হয়। ২ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে উভয়পক্ষের ১০ জন করে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তিন সমঝোতা শর্ত হলো-আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং জশনে জুলুসে যাওয়ার পথে কোনো গাড়িতে মাইক না বাজানো।
বৈঠকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, সেনাবাহিনীর প্রতনিধি মেজর শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী তারেক আজিজ, হাটহাজারী মাদ্রাসার মুফতি ও মুহাদ্দিস আল্লামা জসিম উদ্দীন এবং উত্তর জেলা গাউসিয়া কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
হামলার নিন্দা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের : সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসার শতাধিক ছাত্রকে মারাত্মকভাবে আহত করার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘হাটহাজারী মাদ্রাসা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম দ্বিনি প্রতিষ্ঠান। সেখানে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। মসজিদ ও মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় স্থানে অবমাননা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
মাদ্রাসায় হামলায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের এবং খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। এছাড়া হামলার নিন্দা জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটির আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান এক বিবৃতিতে হামলায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন।
