Logo
Logo
×

সারাদেশ

ঝাড়ফুঁক নয়, ওঝারও ভরসা ভ্যাকসিনে

Icon

এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩১ পিএম

ঝাড়ফুঁক নয়, ওঝারও ভরসা ভ্যাকসিনে

এক সময়ের জমজমাট সাপের খেলা এখন কেবলই ম্লান স্মৃতি। ঠাকুরগাঁও শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শুক্রবার সকালে কাঠের বাক্সে ফণা তুলেছিল গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, দাঁড়াশ আর অজগরের মতো বিষধর ও নির্বিষ সাপেরা।

কিন্তু চারপাশে দর্শকের ভিড় তেমন নেই, যেন আধুনিক সচেতনতার ঢেউয়ে বিলীন হতে বসেছে সাপুড়েদের চিরায়ত এই জীবন।

এই দৃশ্যই বলে দেয় সময়ের পরিবর্তন। আগে যেখানে সাপের খেলা দেখতে মানুষের ভিড় উপচে পড়ত, আর সাপুড়েরা গাছগাছালির ওষুধ বিক্রি করে সংসার চালাত, এখন সেই দিন আর নেই।

এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন দিনাজপুর পৌর শহরের শেখপুরা মহল্লার প্রবীণ সাপুড়ে মো. আইনুদ্দিন (৭৫)। ৪০ বছর ধরে সাপের খেলা দেখিয়ে জীবন পার করেছেন তিনি। এই পেশার আয়েই তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন; কিন্তু এখন সেই ভিড় আর নেই।

হতাশা নিয়ে প্রবীণ এই সাপুড়ে বলেন, আগে ভিড় লেগে থাকত, এখন আর কেউ আসে না।

আইনুদ্দিন জানান, খেলার জন্য সাপ কেনা হয় ঢাকার সাভারের বাজার থেকে, যার বেশিরভাগই আসে ভারত থেকে। একেকটি বিষধর সাপ কিনতে খরচ হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। পেশাগত জীবনের এই পথচলায় একাধিকবার বিষদাঁতের শিকার হয়েছেন তিনি।

আইনুদ্দিনের সরল স্বীকারোক্তি, তিন–চারবার সাপে কামড়েছে। প্রতিবার মেডিকেলে গিয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে সুস্থ হয়েছি। সাপে কামড়ের পর তার ভরসা ভ্যাকসিনে বলেই জানান তিনি।

এই পেশার সঙ্গে চার দশক ধরে যুক্ত আইনুদ্দিনের ওস্তাদ নুর ইসলাম এবং দলের আরেক সদস্য হবিবুর রহমানেরও একই রকম হতাশা। নুর ইসলাম বলেন, আগে গাছগাছালির ওষুধ বিক্রি করে সংসার চলত। এখন আর কেউ কেনে না। দুই–তিন মাস পর খেলা ছেড়ে ফলের দোকান দেব ভাবছি।

হবিবুর রহমানের কথায়, খেলা দিয়ে আর সংসার চলে না। নতুন পথ খুঁজতেই হবে।

সাপুড়েরা খেলার আগে সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফেললেও ঝুঁকি একেবারে দূর হয় না, কারণ প্রতি মাসেই নতুন বিষদাঁত গজায়। ফলে খেলা চলাকালে তাদের প্রায়ই সাপের কামড় খেতে হয়। তবে এই অভিজ্ঞতার বিপরীতে গিয়েও তারা স্বীকার করেন, নিজেদের তৈরি কোনো গাছগাছালির ওষুধেই সেই কামড় থেকে ফল মেলেনি।

আইনুদ্দিন অকপটে বলেন, কাউকে সাপে কামড়ালে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত মেডিকেলে গিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়া। ওঝা বা ঝাড়ফুঁকে সময় নষ্ট করলে রোগীর প্রাণ ঝুঁকিতে পড়ে।

ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম এই সাপুড়েদের অভিজ্ঞতাকেই জনসচেতনতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যারা সাপ নিয়ে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নেন, দিনের শেষে তারাও ছুটে যান হাসপাতালে। তাদের এ অভিজ্ঞতা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—সাপে কামড়ালে ভরসা একটাই, ভ্যাকসিন। ওঝা নয়, চিকিৎসাই পারে জীবন বাঁচাতে।

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাপুড়েদের পেশাগত জীবন ফিকে হচ্ছে, কিন্তু তাদের এই কঠিন অভিজ্ঞতাই যেন সমাজকে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে: কুসংস্কার নয়, বিজ্ঞানের পথেই রয়েছে জীবনের সুরক্ষা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম