‘পালকি’ হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের গল্প
মামুনুর রশিদ মামুন, কেন্দুয়া (নেত্রকোনা)
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৮ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যাতায়াত ব্যবস্থার বিকাশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কিছু উপকরণ আজও স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে আছে।
তেমনই একটি ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম হলো পালকি। সময়ের স্রোতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই পালকি এক সময় ছিল বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক অপরিহার্য অংশ।
গ্রামীণ জনপদে আধুনিক যানবাহনের আগমনের বহু আগে পালকি ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। কাঠ ও বাঁশের তৈরি কাঠামো, উপরে কাপড়ের ছাউনি, ভেতরে আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে পালকি ছিল মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক। সাধারণত চারজন বলিষ্ঠ বেহারা কাঁধে তুলে ধরত পালকি। তারা একসঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটত, গাইত ছন্দময় গান, যা পথের পরিবেশকে করে তুলত আনন্দমুখর।
পালকি শুধু যাতায়াতের জন্যই ব্যবহৃত হতো না; বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানেও এর ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। গ্রামে বরযাত্রা মানেই ছিল ঢাক-ঢোলের তালে তালে পালকিতে চড়ে বরের আগমন। বরযাত্রীরা হেঁটে যেত, আর পালকিতে বসে বর আসত কনের বাড়ি।
বিশেষ করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের কনে বা গৃহবধূদের বাইরে যাতায়াতেও পালকির ব্যবহার ছিল। সামাজিক শালীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নারীদের জন্য এটি ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত বাহন।
এছাড়াও জমিদার ও উচ্চবিত্ত ব্যক্তিরা দূরপাল্লার যাত্রায় পালকি ব্যবহার করতেন। শহর ও গ্রামাঞ্চলের সংযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই পালকি। বেহারাদের কণ্ঠে ছন্দে ছন্দে ‘হে পালকিয়া’ ধ্বনি গ্রামীণ পথঘাটে এক সময় ছিল অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য ও শব্দ।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির অগ্রগতি ও যানবাহনের সহজলভ্যতা পালকির জায়গা দখল করে নেয়। ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, মোটরগাড়ি—সবকিছু ধীরে ধীরে পালকির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। এক সময় এই ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে থাকে। এখন কেবল মেলা, ঐতিহ্যবাহী উৎসব বা নাট্যমঞ্চে পালকির দেখা মেলে—স্মৃতি রক্ষার প্রতীক হিসেবে।
তবুও গ্রামের প্রবীণ মানুষের মুখে আজও শোনা যায় পালকির গল্প। কারও মনে ভেসে ওঠে বিয়ের দিনের আনন্দ, কারও মনে জেগে ওঠে জমিদার বাড়ির শৌর্য-বীর্যের স্মৃতি। পালকি আজ শুধু এক প্রজন্মের স্মৃতিতে নয়, এটি হয়ে উঠেছে আমাদের লোক ঐতিহ্যের এক মূল্যবান দলিল।
কেন্দুয়া চর্চা সাহিত্য আড্ডার সমন্বয়কারী কবি ছড়াকার রহমান জীবন বলেন, পালকি আমাদের ইতিহাসের এক গর্বিত অধ্যায়—যা অতীতকে জানায়, ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সংস্কৃতির শিকড়ে ফিরে যেতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
