চা বাগানে মাদকের আখড়া, দর্শনার্থী সেজে আসে মাদকাসক্তরা
মাধবপুর (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০২ পিএম
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত তেলিয়াপাড়া চা বাগান এখন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে হাত বাড়ালে বিভিন্ন প্রকার মাদক পাওয়া যায়। মাদক বেচাকেনা ও ব্যবহার করা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের। তাদের মাধ্যমেই মাদকসেবীর হাতে সুকৌশলে পৌঁছে দেওয়া হয় মাদক। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারির মধ্যেও নির্বিঘ্নে চলছে ব্যবসা।
প্রতিদিনই ঐতিহাসিক স্থানটিতে দর্শনার্থী সেজে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদকাসক্তরা আসে মাদক সেবনের জন্য। এখান থেকে মাদক নির্মূল করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে শ্রমিকদের সচেতন করা হলেও থেমে থাকেনি। বাগানের ভেতরে গড়ে উঠেছে একটি মাদক সিন্ডিকেট।
এক সময় এখানকার শ্রমিকরা ছিল পরিশ্রমী, সৎ ও নিষ্পাপ মানুষ। তাদের জীবনের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল পরিবার, কাজ আর একটু শান্তি। গত দেড় দশকে বাগানের চিত্র পালটে গেছে।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের পুরোনো শ্রমিক বিশু ভোমিজ বলেন, কোনোদিন ভাবিনি এই বাগানে এমন দিন আসবে। একসময় সন্ধ্যার পর শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে বসে গান গাইত, গল্প করত। এখন সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় অচেনা মোটরসাইকেলের আনাগোনা।
পুরান লাইনের কিছু উশৃঙ্খল যুবক, স্থানীয় প্রভাবশালীর প্রশ্রয়ে বাগানে ঢুকে পড়ে মাদকের কালো ছায়া। এখন বাগানের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি পাড়া যেন মাদক ব্যবসার গোপন ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৫ বছর আগে থেকেই এই সর্বনাশের শুরু। প্রথমে কয়েকজন তরুণ গোপনে চোলাই মদ তৈরি করতে শুরু করে। পরে সেই পথ ধরে আসে গাঁজা, ইয়াবা ফেনসিডিল।
ধীরে ধীরে পুরো বাগান এলাকায় মাদক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে আজ সেটি যেন নিয়ন্ত্রণহীন। বাগানের অলিগলিতে গেলে দেখা যায়, পড়ে আছে খালি ফেনসিডিলের বোতল।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো বিগত দিনে প্রশাসনকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হতো, এমনকি পুলিশ অভিযান চালাতে গেলেও স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক নেতার পক্ষ থেকে হুমকি আসত। একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক সময় পুলিশ মাদক উদ্ধার করলেও গডফাদাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণরা মোটরসাইকেলযোগে বাগানে আসে শুধু মাদক সেবনের জন্য। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়, কিন্তু কিছুদিন পর সব আবার আগের মতোই হয়ে যায়।
তার মতে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ আবারও তৎপরতা শুরু করেছে। ৭ অক্টোবর বিকেলে হরষপুর তেলিয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুহাম্মদ খায়রুল বশরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বনগাঁও হতে ১৭ নম্বর বস্তি তেলিয়াপাড়া চা বাগানগামী কাঁচা রাস্তায় অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানে ২০ কেজি চোলাইমদ সহ ছোটন পান তাঁতী (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। সে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সজল পান তাঁতীর ছেলে।
সাবেক ইউপি সদস্য যোগেন সাঁওতাল বলেন, তেলিয়াপাড়া চা বাগান শুধু একটি শ্রমাঞ্চল নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতীক। তাই এখানকার মাদক সমস্যা দমন করা শুধু আইনি কাজ নয়, এটি জাতীয় দায়িত্বও বটে।
প্রশাসনকে নিয়মিত অভিযান, সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও স্থানীয়দের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা ও গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বর্তমান ইউপি সদস্য সাইমন মর্মু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মাদকের জন্য বহিরাগত লোকজন দায়ী। সামান্য টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল বেকার চা শ্রমিক সন্তানদের এই কাজে জড়িত করেছে।
এখন বহু লোকের নামে মামলা হয়েছে। ইতিহাসের সেই গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি একদিন হারিয়ে যাবে মাদকাসক্ত সমাজের অন্ধকারে।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার দেওয়ান বাহাউদ্দিন লিটন বলেন, বাগান থেকে মাদক নির্মূল করতে আমরা শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করে যাচ্ছি। বাইরের লোকজন মূলত মাদক ব্যবসা ও এ কাজে অর্থলগ্নি করেন। তাদের আগে আইনের আওতায় নিতে হবে।
মাধবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শহিদ উল্যা বলেন, চা বাগান থেকে মাদক দূর করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাদক সংক্রান্ত কোনো তথ্য পেলে পুলিশের সব ইউনিট একযোগে অভিযান করে। বহু দাগী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


