ফ্যাসিস্ট আমলের মতোই চলছে উন্নয়নের নামে লুটপাট
গৌরীপুরে কোটি টাকার রেলপথে একদিনও চলেনি ট্রেন
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১৭৬০ মিটার রেলপথে একদিনও চলেনি ট্রেন। ১০ বছরেও মেলেনি সিগন্যাল পয়েন্টের মালামাল। এই অচল রেললাইন সচল না করে নতুন করে লাইন নির্মাণ শুরু হয়েছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনে।
জানা যায়, স্টেশনের আউটার সিগন্যাল থেকে গৌরীপুর স্টেশন পর্যন্ত এক কিলোমিটার ও নেত্রকোনাগামী রেলপথের আউটার সিগন্যাল থেকে স্টেশন পর্যন্ত ৭৬০ মিটার রেলপথ পুনর্নির্মাণ হয় ১০ বছর আগে। কিন্তু এটাকে অব্যবহৃত রেখে এই স্থানে নতুন করে আবার নির্মাণ করা হচ্ছে রেললাইন। নতুন করে নির্মাণের ব্যয় ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তথ্য গোপন করে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজে ফ্যাসিস্ট আমলের মতোই চলছে লুটপাট।
সরেজমিন বুধবার গৌরীপুর জংশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশন এলাকায় ১০ বছর আগে নির্মিত ৪নম্বর ও ৫নম্বর রেললাইনের রেল, স্লিপার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই স্থানে মাটি সমান করে নতুন রেললাইন নির্মাণে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে প্রকল্পের শর্তানুযায়ী, প্রকল্পের বরাদ্দ, কাজের ধরন, সময়সীমা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তথ্য সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু হলেও এ নিয়ম মানা হয়নি।
স্টেশন এলাকার একাধিক দোকানদার বলেন, ‘আগেরটাই চলে নাই। আবার নতুন করতেছে। এটাও তো ওই রকমেই হবে।’
এ প্রসঙ্গে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার সফিকুল ইসলাম বলেন, কাজ করছে দেখছি। কে বা কারা করছে, কী কাজ হবে এসব তথ্য আমার জানা নেই।
কাজ তদারকিতে নিয়োজিত ঠিকাদারের প্রতিনিধি আবুল কালাম বলেন, তিনিও বিস্তারিত কিছু জানেন না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামও তার জানা নেই।
সিনিয়র উপ-প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, তিনি প্রশিক্ষণে আছেন, তাই এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না। রেলওয়ে ময়মনসিংহের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর মুঠোফোনে কল দিলে প্রথমে তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। প্রকল্প এলাকায় প্রজেক্ট প্রোফাইল নেই, সেখানে জনস্বার্থে ও প্রচারার্থে এসব তথ্য থাকা বাধ্যতামূলক-এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে আছি।
রেললাইন মেরামত কাজের এ তথ্য সংগ্রহে বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও কেউ কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। গৌরীপুর রেলওয়ের যাত্রী গাভীশিমুল গ্রামের সাদেকুর রহমান বলেন, ফ্যাসিস্টের আমলেও তথ্য গোপন করে উন্নয়ন বাজেট লুটপাট হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদিন সাগর যুগান্তরকে বলেন, গৌরীপুর জংশনকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেই। যখনই স্টেশনে আসি, দেখি এদিকে-সেদিকে মেরামত করছে। কে করছে, কী করছে, কেউ জানে না। আমরা সেই ‘জানে না’ দেশে এখনো বসবাস করছি।
জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে এই জংশনের ৪ ও ৫নম্বর রেললাইন মেরামত করা হয়। সংস্কারকৃত রেললাইনের বিষয়ে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার তোফাজ্জল হোসেন গাজী নিশ্চিত করেছিলেন, এ নির্মাণকাজ ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ হয়েছে। ট্রেন চলাচলের ফিটনেস পরীক্ষা শেষে সংস্কারকৃত রেললাইন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সিগন্যাল অপারেশন বিভাগের কাজ। তবে ১০ বছরেও এ বিভাগের কাজ শেষ হয়নি। ওই সময় গৌরীপুর স্টেশনের সিগন্যাল অপারেটর মো. তারিকুল আলম জানান, বছরের পর বছর লাইন অচল থাকায় সিগন্যালের সব পয়েন্ট বিকল হয়ে গেছে। নতুন সরঞ্জামাদি না আসা পর্যন্ত লাইন সচল করা সম্ভব নয়। ময়মনসিংহ কেওয়াটখালীর (সিগন্যাল) সিনিয়র সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সারোয়ার জাহান জানান, দুটি রেললাইন সচল করার জন্য সিগন্যাল পয়েন্টে মালামালের জন্য প্রস্তাবনা ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রেরণ করা হয়েছে। এসব তথ্য উঠে আসে দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদনে।
এ ছাড়াও ‘গৌরীপুরে রেললাইন সংস্কারে পুরোনো স্লিপারের ব্যবহার’ শিরোনামে কাঠের অধিকাংশ স্লিপার (সিলভার) ঘুনে ধরা, পচা ও নষ্ট, পুরোনো রেললাইন ব্যবহার। এসব প্রতিবেদনের পরেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ ছিল।
এদিকে সেই রেললাইনে নতুন কাজ শুরু হলেও তথ্য জানে না কেউ। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের মতো তথ্য গোপন করে উন্নয়নের নামে হরিলুটের অভিযোগ এলাকাবাসীর। গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ফকির বলেন, আমরা ২০১৫ সালে বলেছিলাম, ‘যখন সিগন্যালের মালামাল আসবে হয়তো তখন এ রেললাইনের আর ফিটনেসই থাকবে না। আজকে সেটাই প্রমাণ হয়েছে। তখনো অভিযোগ ছিল আমাদের, রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তরগুলোর কাজের সমন্বয় নেই। এখনো বলছি, উন্নয়ন হতে হবে জনস্বার্থে। গৌরীপুর জংশনকে আধুনিকায়ন না করে, এসব সংস্কার আর মেরামতের নামে লুটপাট চলছে। অপরিকল্পিত এ উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কাজে আসছে না। ফলে জনগণের টাকা সরকার বিনষ্ট করছে।’

